পাঠপ্রতিক্রিয়া
আফটার দ্য কুয়েক: হারুকি মুরাকামি
মোজাম্মেল হক নিয়োগী
হারুকি মুরাকামি জাপানের জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক। তিনি খুব বেশি বই লিখেননি, হাতে গোনা কয়েকটি। তন্মধ্যে অ্যা ওয়াইল্ড শীপ চেজ, দ্য উইন্ড বার্ড ক্রনিকল, কফকা অন দ্য সোর, নরওয়েজিয়ান উড, হেয়ার দ্য উইন্ড সিং, ড্যান্স ড্যান্স ড্যান্স এবং আফটার দ্য কুয়েক উল্লেখযোগ্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি প্রায় বিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং সাহিত্যে তিনি নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন— এমন কথা সাহিত্যবোদ্ধাদের মধ্যে আলোচিত হচ্ছে বিগত কয়েক বছর যাবৎ। যদিও সৌভাগ্যের তিলকটি এখনো তাঁর পরা হয়নি, বলা তো যায় না ভাগ্যের চাকা যদি ঘুরে যায় তাহলে হয়তো সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মানের তকমাটিতিনি পেয়েও যেতে পারেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা এবং বাস্তবতার মিশেলে সাহিত্যে যে–ধারাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুরাকামির রচনাতেও সে ধারাটি দীপ্যমান। বলা হয়ে থাকে পশ্চিমাসাহিত্যে প্রভাবিত মুরাকামির সাহিত্যকর্মে উইলিয়াম ফকনার, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সাহিত্যের আঁচ পাওয়া যায়।
হারুকি মুরাকামির `আফটার দ্য কুয়েক’ ১৩২ পৃষ্ঠার গল্পগ্রন্থটিতে ছয়টি গল্প সংকলিত হয়েছে। ১৯৯৫ সালের কোবের ভূমিকম্পের পটভূমিতে গল্পগুলো রচিত হলেও গল্পে কোথাও ভূমিকম্পের চিত্র চিত্রিত হয়নি, বরং বলা যায় ভূমিকম্পের নিদারুণ ভয়, আতঙ্ক, কষ্ট, মনস্তাপ ও কান্নার শব্দহীন বিমূর্ত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে প্রতিটি গল্পের চরিত্রগুলোর মনোজগতে। ভূমিকম্পের পর মানুষের মনে যে–ধরনের প্রভাব পড়ে তারই শিল্পিত বিমূর্ত ও প্রচ্ছন্ন চিত্র এই গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পে খোদিত হয়েছে। লেখক সচেতনভাবেই হয়তো গল্পে ভূমিকম্পের বর্ণনায় কিংবা বাস্তবানুগ দুর্ঘটনার মর্মস্পর্শী বর্ণনায় কোনো গল্প এখানে গ্রন্থিত করেন নি, তবে প্রতিটি গল্পের প্রতিটি চরিত্র মমস্পর্শী আর্তনাদ আর কষ্টের উত্তাপে নিষিক্ত হয়েছে।
`ইউএফও ইন কুশিওর’ শিরোনামের প্রথম গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র সেল্সম্যান কমোরা এক সুদর্শন যুবক যার কিনা বিয়ের আগে অনেক সুন্দরী বান্ধবীর সঙ্গে অবাধ মেলামেশা ছিল, কিন্তু বিয়ের পর এক অসুন্দরী, বেঁটে স্ত্রীর প্রেমের মোহাচ্ছন্ন হয়ে দোকান আর বাসা ছাড়া সে সব কিছু ত্যাগ করে সংসারী হয়েছে। আর সেই স্ত্রীই একদিন কিছু না বলেই বাসা থেকে উধাও হয়ে যায় এবং যাওয়ার সময় শুধু একটা চিরকুটে লিখে যায়, `ইউ হ্যাভ নাথিং ইনসাইড ইউ দ্যাট ইউ ক্যান গিভ মি.’। এই বাক্যটিতে কমোরার জীবনের এক প্রচ্ছন্ন শোকগাথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অন্তর্দহন নিবৃত্তির জন্য কমোরা দীর্ঘদিনের ছুটি নিজ শহর থেকে অন্যত্র গেলে বন্ধুর প্ররোচনায় তার বন্ধুর বোনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও শিমাওর সঙ্গে দৈহিক মিলনে ব্যর্থ হয়। তখন শিমাও কমোরার বুকে আঙুল দিয়ে লিখে, `ইউ আর জাস্ট অ্যাট দ্য বিগেনিং।’ নরওয়েজিয়ান ওডে যৌনতার যে–রকম খোলামেলা বর্ণনা পাওয়া যায় ‘আফটার দ্য কুয়েক’গল্পগ্রন্থে তেমন খোলামেলা বর্ণনা না দিয়ে লেখক পরিমিত বোধের স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে কমোরার হয়তো অত্যধিক মানসিক চাপের বা ভয়ের কারণেই শারীরিক বিপর্যয় ঘটেছে এবং যৌন অক্ষমতা প্রকট রূপ ধারণ করেছে বলেই তার স্ত্রীর অন্তর্ধান হয়ে যাওয়ার কারণ, লেখক তা অত্যন্ত সুকৌশলে শিল্পের রঙে বাঙময় করেছেন। মনোকষ্টের কারণে জীবনের বিপর্যয়ের ঘটনাটি সরাসরি উল্লেখ না করে দুটি ঘটনায় লেখকগল্পের অন্তর্দশন চিত্রিত করেছেন। আরও উল্লেখ্য যে, গল্পটি যেভাবে রচিত হয়েছে তাতে কোথাও মনে হবে না ভূমিকম্পের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গল্পের বিষয়বস্তু। কিন্তু কমোরার জীবনের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে গল্পের অন্তর্নিহিত বক্তব্য থেকে ভূমিকম্পের সঙ্গে সম্পর্ক কোথায় তা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকের। হয়তো এখানেই গল্পটির সার্থকতা।
`ল্যান্ডস্ক্যাপ উইথ ফ্ল্যাটআইরন’, দ্বিতীয় গল্পেও গল্পের নায়কের একাকীত্ব জীবনের একটি ছবি অঙ্কিত হয়েছে। এই গ্রন্থের সবচেয়ে ভালোলাগা (আমার কাছে) গল্পের বয়স্ক নায়কের সঙ্গে এক তরুণীর নিষ্কাম প্রেমের আভাস পাওয়া যায়। গল্পের নায়ক একজন চিত্রশিল্পী যে প্রতিরাতে সমুদ্রের ভাসমান কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বহ্নুৎসব করে রাত কাটায়। তার জীবনযাপনও অত্যন্ত সাদাসিদে; প্রতিদিন একই প্রকার খাবার দোকান থেকে কিনে খেয়ে জীবন ধারণ করে, সে নিজের বাসায় ফ্রিজে কোনো কিছু রাখে না। এই শিল্পীর চরিত্রে একটি ভীতির রেখা লেখক এঁকেছেন যে, সে ফ্রিজকে ভয় পায় এবং তার মনে হয় সে ফ্রিজে আটকা পড়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবে। একাকী জীবনযাপনের কোনোরূপ বৈচিত্র্য নেই। আপাতদৃষ্টিতে তাকে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও তার ভিতরে যে দহন তা কোনোভাবে প্রকাশ করা হয়নি। রাতের বেলায় সমুদ্র সৈকতে বহ্নুৎসব করে সময় কাটায় এই শিল্পী যে একটি কেবল ‘ইস্ত্রির’ ছবি এঁকেছে, এই ছবিকে বড় ধরনের শিল্পকর্ম মনে করছে, এসব কথা সে তার নিষ্কাম প্রেমের বান্ধবীর বহ্নুৎসবের সময় বলে, আর ধীরে ধীরে রাত গভীর হলে তারা সমুদ্র সৈকতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। গল্পটি পড়ে শেষ করার পর মনে হয় সম্পূর্ণ সমুদ্র সৈকতটি বিষাদে ছাওয়া।
`অল গড’স চিলড্রেন ক্যান ড্যান্স’—তৃতীয় গল্প; এতে পরাবাস্তবতা ও অলৌকিক চরিত্রের সন্ধান মিলে। ইউশিয়া, গল্পের নায়ক যখন ১৭ বছর বয়সে পা রাখে তখন মা তার জন্মরহস্যের কথা বলে। ইউশিয়ার পুরুষাঙ্গ অস্বাভাবিক বড় যা মাও জানে এবং মা তা বিশ্বাস করে যে, ইউশিয়া ইশ্বরপুত্র বলেই তার পুরুষাঙ্গ এতো বড়। ইয়োশিয়ার জন্মের কাহিনিতে মা প্রকাশ করে, জন্ম–প্রতিরোধক ব্যবহার করার পরও মা গর্ভবতী হতো ও গর্ভপাত ঘটাত এবং একদিন এক ডাক্তার যার কিনা কানের লতি কুকুরে খেয়ে ফেলেছে তাকে এ–ঘটনা বলার পর সে ডাক্তার এসব কথা অবিশ্বাস করে এবং পরে নিজেই জন্ম–প্রতিরোধক ব্যবহার করে মিলিত হলে ইউশিয়ার জন্ম হয়েছে। একদিন সেই মানুষটিকে সে খুঁজে পায় যার কানের লতি কুকুরে খেয়ে ফেলেছিলএবং সে ভাবে এই লোকই তার বাবা। ওরা গলির পথ ধরে এগিয়ে যায়, লোকটি একসময় অন্ধকারে হারিয়ে গেলে ইউশিয়া একা একা নাচতে থাকে; গল্পটি এভাবেই শেষ হয়। এই গল্পেও লেখক একাকীত্বের মর্মবেদনার ঝংকার তুলেছেন যা ইউশিয়ার নাচের মাধ্যমে অতল অন্ধকার প্রাচীরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে আর সেই প্রতিধ্বনি গিয়ে আঘাত করে পাঠকের মনেও। প্রতীকী এ গল্পে ভূমিকম্পের ফলে সর্বস্ব হারানো মানুষের নিঃসঙ্গতার গভীর সঙ্কট চিত্রিত করেছেন লেখক।
`থাইল্যান্ড’ একটি চমৎকার গল্প। এই গল্পেও অলৌকিক কিংবা ঐন্দ্রিজালিক বিষয়ের কিঞ্চিৎ সন্ধান মিলে। গল্পের নায়িকা একদিন থাইল্যান্ডে একটি কনফারেন্স করতে গিয়ে এক চিরকুমার গাড়িচালকের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সময় একদিন ড্রাইভার এই নারীর কাছে একটু সময় প্রার্থনা করে অতিশয় বৃদ্ধা এক নারীর কাছে নিয়ে যায়। সেই নারী মানুষের শরীরে বা মনে কিছু থাকলে বলতে পারে অলৌকিক জ্ঞানে। সেই বৃদ্ধা বলল, তোমার পেটের ভিতরে একটি পাথর আছে, যেখানে জাপানি ভাষায় কিছু লেখা আছে যা আমি পড়তে পারি না।’ অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন এই গল্পটিতে যে–পাথরের কথা বলা হয়েছে সে পাথরটি কী লেখক তা প্রকাশ করেননি বটে তবে পাঠকের হয়তো বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়, এটি কষ্টের পাথর, যে পাথরে তার অব্যক্ত কষ্টের কথা লেখা আছে, যা না সরালে তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। মানুষ যদি নিজের কষ্টের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ না করে তা মানসিক চাপ বাড়ে, মানসিক চাপের ফলে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়—এটি স্বতসিদ্ধ। এখানে কোবের সর্বস্ব হারানো মানুষের নিঃশব্দ অন্তর্দহন তারই প্রতিফলন
একটি ব্যাঙ টকিওকে ভূমিকম্পের হাত থেকে রক্ষা করবে! বড় অদ্ভুত ব্যাপার। ‘সুপার–ফ্রগ সেভস টকিও’ গল্পটি মূলত এক মোহাচ্ছন্নতার গল্প। কাটাগিরির বাসায় একদিন এক সুপার ব্যাঙের দেখা মেলে যে চা–কফি সব খায় আর কাটাগিরি সঙ্গে গল্প করে। এই ব্যাঙটিই টকিওকে ভূমিকম্প থেকে রক্ষা করবে। গল্পটি হাস্যরসাত্মক হলেও শেষের দিকে এসে বাঁক বদল করে এবং পাঠকের মনে নানা রকম প্রশ্নের খোঁচা দেয়। হাসাপাতালে যখন কাটাগিরিকে নার্স ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াতে চায় তখন বোঝা যায় স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে সে পৃথক করতে পারে না। আহমাদ মোস্তফা কামালের ‘স্বপ্ন ও বাস্তবতার গল্পে’ও দেখা যায় নায়ক তার স্ত্রী ধর্ষিতা হয়েছে তা স্বপ্ন না বাস্তব তাও পৃথক করতে পারে না। এখানে মনোবৈকল্যের আভাস মিলে এবং কাটাগিরির কষ্টের ছাপ যেন পাঠকের মনেও রেখে যায়।
ভূমিকম্পের ভয় ও আতঙ্কের ফলে মানসিক ও স্নায়ুবিক বৈকল্যের নিবিড় ও ঘন প্রচ্ছায়ায় `হানি পি’ গল্পটিতে লেখক যেন প্রকৃত সত্তাকে উন্মোচন করেছেন। জুনপাই, এক গল্পকার যে ছোটগল্প লিখে এবং গল্পের মাঝেই সে জীবন ও জীবিকার অনুসন্ধান করে। একটি গল্পেই নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে, লিখে, কাটাকুটি করে ঠিক করে। তার প্রিয় দুজন বান্ধবী, ত্রিভুজ প্রেমের বিস্তার ঘটে এবং যখন জুনপাইয়ের আরও নিবিড় ঘনিষ্টতার সুযোগ আসে তখন সে আতঙ্ক ও সন্দেহের বেড়াজালে অন্তর্নিবিষ্টহয় যার কিছুই বলার বা করার থাকে না। জুনপাই জীবনের করুণ ট্র্যাজেডির দিকে এগিয়ে যায়; জুনপাইয়ের সম্পর্কের সমস্ত তার ছিঁড়ে যায়; সে নিঃসঙ্গতার নিতল গহŸরে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকে। গল্পগ্রন্থটি পাঠ শেষে মনে এক প্রকার মোহাচ্ছন্নতায় ঢাকা পড়ে। প্রতিটি গল্পের অত্যন্ত দরদ দিয়ে বইটির অনুবাদ করেছেন জে রবিন, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জাপানি প্রভাষক। প্রকাশক: ভিনসেট, লন্ডন।