দেশ কালোত্তীর্ণ উপাখ্যান: মোজাম্মেল হক নিয়োগী

সাহিত্যাঙ্গনে আলব্যের কামু কেবল সুপিরিচিত নন, বহুল আলোচিতও। তিনি আলজেরিয়ার অধিবাসী হলেও ফ্রান্সে বসবাস করেছেন। হয়তো এজন্যই তার নামের বানানে বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। যেমন, Alber Kami, ফরাসিতে Albert Camus। বাংলায়ও বিভিন্ন বইয়ে তার নামের বানানের বিভিন্ন রূপ পরিলক্ষিত। যেমন, আলব্যের কামু, আলবের ক্যামু ও কাম্যু। আলবের বা আলব্যের যাহোক না কেন, উচ্চারণে এত জটিলতায় স্বরতন্ত্রের নানা রকম ব্যায়াম করার বিপদে যেতে চাই না। সরাসরি আলবের কামু উচ্চারণ করে স্বরতন্ত্রকে কষ্ট থেকে অব্যাহতি দিতে চাই। যদিও উচ্চারণগত ভুল রয়েছে, তবু মার্জনা স্বরূপ বিদেশি নামের বানানের জন্য কিঞ্চিৎ খাতির প্রত্যাশা করি।

১৯১৩ সালে নভেম্বরের ৭ তারিখ কামুর জন্ম পূর্ব আলজেরিয়ার মেন্ডোবিতে (বর্তমান নাম আন্নাবা)। তার বাবা লুসিয়েন অগাস্তে কামু ছিলেন একজন কৃষি-শ্রমিক। ১৯১৪ সালে আগস্টে জার্মান সৈনিকদের আক্রমণে তিনি আহত হয়ে মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ১১ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। মা কাথেরিন হেলেন সিন্টুস ছিলেন গৃহিণী। বাবার মৃত্যুর পর সামান্য পেনশন দিয়ে কায়ক্লেশে তারা দিনাতিপাত করতেন।

যুদ্ধের পর মা মানুষের বাড়িতেও কাজ করতেন। কামুরা দুই ভাই সরকার থেকে লেখাপড়া ও চিকিৎসার জন্য সামান্য অর্থ পেতেন। তবে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের টিকে থাকতে হয়েছে। কামু ছিলেন সদাচরণের মানুষ। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার উদার মানসিকতাও ছিল।

দারিদ্র্যের প্রতিকূল স্রোতে জীবন তরীর দাঁড় টেনে ক্লান্ত হলেও আলজেরিয়ার নৈসর্গিক রূপ প্রাচুর্যে শৈশবে কামু মুগ্ধ হতেন। সংকটে ও প্রাচুর্যে যাপিত জীবনের মানস গঠিত হয় বিভিন্ন উপাদানে যা পরবর্তী জীবনদক্ষতা ও জীবন গঠনে অনেকের জীবনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সৃজনশীল মানুষের বেলায় তা বিরল প্রাপ্তি। ঘাতের জন্য প্রতিঘাত যেমন তৈরি হয় ঠিক তেমনি ঘাতের সমবেদনাও তৈরি হয়। প্রাচুর্য থেকে জীবনের বৈচিত্র্য উপভোগ করার সুযোগ কোথায়? কামুর মানসরূপ গঠিত হয়েছে বিষম সংকটে, জীবনকে শৈশব থেকেই উপভোগ করেছেন নানা মাত্রার মায়ায় তেজে ও রহস্যে। মনের ভেতরে নির্মিত বর্ণিল বিচিত্রমুখিতার তেজোদীপ্তময় আভা ছড়িয়ে পড়ে তার যৌবনের কর্মে, লেখায় ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত হয় জগত ও জীবনের অনুপুঙ্খ বিষয়াবলি। সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে দর্শনের জ্যোতির্ময় কিরণ।

খেলাধুলার প্রতিও কামুর ছিল অদম্য আকর্ষণ। ফুটবলের প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ এবং গোলকিপার হিসেবে খেলতেন। সাঁতার, রাগবি, বুলফাইটিং, মুষ্ঠিযুদ্ধ ইত্যাদি খেলাও তাঁর জীবনের সঙ্গে মিশে থাকত। দুঃসাহসিক অভিযান। কামু কি আর সেখানে থেমে থাকার মানুষ! পাহাড় কিংবা সাগরের উদ্দেশে ছুটতেন যখনই ইচ্ছে হতো। তার জীবনাচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তিনি সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। তার সদাচরণে মানুষও তাকে কাছে টানতো। দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই তাকে অবহেলা করলেও তিনি অকপটে মেনে নিতেন এবং তাদের প্রতি কখনো রূঢ় আচরণ করেছেন বলে প্রমাণ মেলে না।

ছাত্রাবস্থায় তিনি লেখালেখিতে ঝুঁকে যান। ১৯৩২ সালে Sud-এ তার প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকায় তার সমাজ বিজ্ঞান ও নৈতিকতা বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসিত হয় বিদ্বজ্জনের দ্বারা। তিনি ইউনিভার্সিটি অব আলজিয়ার্সের দর্শনের অধ্যাপক জাঁ গ্রেনিয়রের সান্নিধ্যে আসেন এবং বিখ্যাত দার্শনিকদের সম্পর্কে তথা তাদের দর্শনশাস্ত্র সম্পর্কে গভীরভাবে জ্ঞানার্জন করেন। এই তো কামুর কালজয়ী লেখা ও বিখ্যাত হওয়ার মাল-মসলা যেগুলোর তিনি সদ্ব্যবহার করতে পেরেছেন অনুধ্যান উদারতায় সর্বসাকুল্যে।

কামু সিমন হির নাম্নী এক নারীর প্রেমে পড়েন এবং ১৯৩৪ সালে বিয়ে করেন। তিনি নেশা করতেন প্রচুর, ছিলেন যক্ষায় আক্রান্ত এবং প্রেমের প্রবল জোয়ার বিয়ের পরে কিছুটা ভাঁটা পড়ায়, কামু স্ত্রীর প্রতি বেশ উদাসীন ছিলেন। পক্ষান্তরে, যক্ষায় আক্রান্ত স্বামীর প্রতিও সিমনের আকর্ষণ ক্রমে ফিকে হয়ে এলে এক ডাক্তারের প্রেমে মজেন। স্ত্রীর পরকীয়ার ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর ১৯৪০ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।

লেখালেখি আর খেলাধুলার পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতেও জড়িয়ে যান। তার পরিবার ক্যাথলিক ফেইথের বিশ্বাসী থাকলেও ধর্মের প্রতি তার কোনো আকর্ষণ ছিল না। সোজাসাপটা কথা, তিনি কোনো ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে দুই বছর কাজ করে (১৯৩৫-১৯৩৭) পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। কামু নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। স্টালিনকে অপছন্দ করতেন তীব্রভাবে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কামুর কণ্ঠস্বর ছিল আপসহীন। তার প্রতিবাদের সোচ্চার কণ্ঠস্বর কম্পন জাগায় উত্তর আফ্রিকার মুসলমানদের নির্যাতনকারী মানুষদের বুকেও। এ কারণেই সুইডিশ অ্যাকাডেমি নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সময় বলেছিল, কামু পুরস্কৃত হচ্ছেন foremost literary antagonist of totalitarianism হিসেবে। কমিউনিস্ট পার্টিতে থাকাকালীন ফ্রান্সের বড় বড় নাট্যকারদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং নাটক নিয়ে তুমুলভাবে জড়িয়ে পড়েন। এই সময়ই সার্ত্রের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়।

অস্থিরতা ছিল কামুর জীবনের নিত্যসঙ্গী। কোথাও যেন মন বসাতে পারেন না। বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ফ্রান্সে চলে আসেন এবং প্যারিস-সোয়ের (Paris-Soir) একটি দৈনিকে কাজ শুরু করেন। এখানেও স্থায়ী হতে পারলেন না। ১৯৪০ দ্বিতীয় বিয়ে করেন Francine Faure নামের এক নারীকে। Francine Faure ওরানে চলে যান শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে। কামু আরও দু-একটি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প মেয়াদের চাকরি শেষে তিনিও ওরানে চলে যান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তার কাশিতে রক্ত দেখা দিলে আবার ফ্রান্সে চলে আসেন। এই সময় বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তার সখ্য হয় এবং নাটকের প্রতি ঝুঁকে যান। কামুর আলোচনা করতে গেলেই সার্ত্রর আলোচনা চলে আসে। সার্ত্র কামুর আট বছরের বড় হলেও কামুর প্রতিভা দিয়ে তিনি তাকে ডিঙিয়ে যান। তবে সার্ত্র ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ এবং কামুর উত্থানের জন্য বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে সিঁড়ি তৈরি করতে তিনি ছিলেন অকৃপণ ও অকৃত্রিম। বিদগ্ধ সাহিত্যিকরা বলে থাকেন, কামুকে নিয়ে তার একটি প্রবন্ধই কামুর খ্যাতি ও পরিচিতির সীমা ছাপিয়ে যায়।

অচেনা
১৯৪২ সালে ফেব্রুয়ারিতে গালিমার প্রকাশ করলো তার আলোচিত ও বিখ্যাত উপন্যাস L’Etranger যার ইংরেজি করা হয়েছে The Outsider এবং বাংলায় অচেনা, আগন্তুক বা অপরিচিত ইত্যাদি শব্দে অনুবাদ করা হয়। মূল উপন্যাসটি ফরাসি ভাষায় লেখা হলেও ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হওয়ার পরই মনে হয় এই উপন্যাসের পাঠক সারা পৃথিবীতেই বইটি পড়ার সুযোগ পান। ইংরেজি কিংবা ফরাসি ভাষায় নয়, ‘উপন্যাস ত্রয়ী’ (আউটসাইডার, ফল ও দ্য প্লেগ) নালন্দা প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৬ সালে প্রকাশিত গ্রন্থটি পড়ার সুযোগ হয় এবং আলোচনা করার জন্য প্রয়াসী হই। সত্য স্বীকার করা ভালো যে, কামুর উপন্যাস নিয়ে নতুন করে আলোচনা করা এক প্রকার ধৃষ্টতা। কারণ তাকে ও তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে সারা পৃথিবীতেই বিদগ্ধ সাহিত্যিক ও সমালোচকগণ এত বেশি আলোচনা করেছেন, যা খুব কম লেখকের ভাগ্যেই এ-রকম ঘটেছে। এসব সাহিত্যবোদ্ধার সমৃদ্ধ আলোচনার পাশে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস কতটুকু মানাবে তা নিয়ে সন্দিহান। তবু মনের তাগিদে কিছু লেখার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই লেখার সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র। আলোচ্য গ্রন্থের আউটসাইডার বাংলায় অনুবাদ করেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তিনি সরাসরি ইংরেজি থেকে, না কি ফরাইস ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন, তা উল্লেখ আছে কি না গোচরে আসেনি। ফরাসি ভাষায় লেখার কারণে নামের বানান ও উচ্চারণও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম দেখতে পাওয়া যায় যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। যাহোক, এই প্রবন্ধে প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনূদিত উপন্যাসটির আলোকেই কিছুটা আলোচনা করার প্রয়াস নিয়েছি। প্রেমেন্দ্র মিত্র আউটসাইডারের বাংলা শিরোনাম করেছেন ‘অচেনা’।

নিয়ে মামলা হলে ম্যুরসো রেমন্ডের পক্ষে থানায় সাক্ষী দিলে অফিসার রেমন্ডকে ভর্ৎসনা করে বের করে দেয়। মামলাটি থানায় শেষ হলেও মেয়েটির ভাই রেমন্ডকে খুন করতে পিছু নেয়।

‘অচেনা’ উপন্যাসটি নয়টি পরিচ্ছদে নব্বই পৃষ্ঠার মধ্যে বিস্তৃত। আউটসাইডার অধিক অধিত গ্রন্থ হিসেবে এর কাহিনি সুবিদিত এবং অনেক সাহিত্যামোদীর উপন্যাসটির পড়া না হলেও মুখে মুখে শুনে কাহিনির নির্যাস করোটিতে স্থান করে নিয়েছে। অনেক সাহিত্যবোদ্ধার মতে, আউটসাইডার বা অচেনা পড়ার আগে কামুর দর্শন সম্পর্কে জানা আবশ্যক। বিশেষ করে The Myth of Sisyphus’ ‘Absurdity’ or ‘Absurdism’ and ‘Nihilism’; এই তিনটি বিষয় জেনে উপন্যাসটি পড়লে এর সারগর্ভ, ব্যাপকতা এবং নিবিড় পাঠে গভীর অনুধ্যানের সৃষ্টি করতে পারে বলে অনেকের ধারণা। অন্যথায় একটি সাধারণ মানের উপন্যাস হিসেবেই পাঠকের মনে ঠাঁই পেতে পারে। উল্লিখিত তিনটি বিষয় নিয়ে এই প্রবন্ধের শেষে সামান্য আলোকাপাত করার ইচ্ছে রেখে মূল উপন্যাসের বিষয়গুলোর দিকে দৃকপাত দিতে চাই।

‘অচেনা’ উপন্যাসের স্টোরি লাইন বা অতি সংক্ষেপে সারকথা হলো, ম্যুরসো নামের এক যুবক মায়ের মৃত্যুর পর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে কোনো শোক প্রকাশ করেনি বা কাঁদেনি। তার পরের দিনই মেয়েবন্ধুর সঙ্গে থাকে এবং এরপর একদিন বন্ধুদের সঙ্গে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যায়। সৈকতে তার বন্ধুকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ঘোরাফেরা করছিল এমন এক আরব যুবককে সে গুলি করে হত্যা করে। আদালতেও অকপটে স্বাভাবিকভাবে খুনের কথা স্বীকার করে এবং তার ফাঁসির রায় হয়। রায়ের আগে উকিলের বারবার জেরা করেছিল মায়ের মৃত্যুর পর কেন সে কাঁদেনি। এই যুক্তিটিকে উকিল জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করে প্রমাণ করে সে ঠাণ্ডা মাথার খুনি যার ভিত্তিতে তার ফাঁসির রায় হয়। সে দেশের প্রথা অনুযায়ী মায়ের মৃত্যুতে না কাঁদা একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় যা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।

দশটি অধ্যায়ে নব্বই পৃষ্ঠায় বিস্তৃত এই উপন্যাসের এ-রকম সারকথা কি পাঠকের মন ভরবে? এইটুকু কারণেই কি উপন্যাসটি এত বিখ্যাত ও আলোচিত—অতৃপ্তি ও বিতৃষ্ণায় পাঠকের মনে প্রশ্ন দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। অতৃপ্তি ও বিতৃষ্ণা থেকে মুক্ত করতে তাহলে গল্পের সারকথার অক্ষপথ ঘুরে আরেকটু বাড়িয়ে বলা যাক। এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন যে, দশটি পরিচ্ছদে উপন্যাসটি রচিত হলেও এর দুটি বিভক্তি রয়েছে। প্রথম ভাগে ম্যুরসোর জীবনযাপনের গল্প এবং দ্বিতীয় ভাগে খুনের কারণে গ্রেফতার হওয়া থেকে মৃত্যুদণ্ডের রায় পর্যন্ত গল্প।

উত্তম পুরুষে লেখা কামু রেমন্ড ম্যুরসোর চরিত্রটি এমনভাবেই সৃষ্টি করেছেন যার মধ্যে কোনো অনুভূতি আছে বলে মনে হয় না। সে আলজিয়ার্সে কোনো কোম্পানিতে চাকরি করতো। আলজিয়ার্স থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে মারেঙ্গোর এক বৃদ্ধাশ্রমে তার মা থাকতেন। একদিন ম্যুরসো টেলিগ্রামের মাধ্যমে জানতে পারল মা মারা গেছেন। ছুটির জন্য মালিকের কাছে আবেদন করলে মালিক মনে হয় বিরক্ত হয়েছেন এই ভেবে সে আক্ষেপ করে বলল, ’দেখুন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। বুঝতেই তো পারছেন এতে আমার কোনো হাত নেই।’ মালিক কোনো কথা না বলেই ছুটি দিলেন।

ছুটি পাওয়ার পর যথারীতি অন্যান্য দিনের মতো সেলেস্তির রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেয়ে বাসে যাত্রা শুরু করে। পথের ঝক্কিঝামেলা, রোদের উত্তাপ আর ক্লান্তি নিয়ে সন্ধ্যার পর গিয়ে পৌঁছায় আশ্রমে। আশ্রমে যাওয়ার পর সেখানকার কর্মচারী বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সমবেদনা দেখাতে চাইলেও ম্যুরসোর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই প্রকাশ পায়নি। ওয়ার্ডেন কফিনের ডালা খুলে মায়ের মুখ দেখাতে চাইলেও ম্যুরসো বলল, ‘প্রয়োজন নেই’। সন্ধ্যার পর ওয়ার্ডেনের সঙ্গে কফি পান করেছে, সিগারেট টেনেছে মায়ের কফিনের পাশে বসেই। ঘটনার বিবরণটিতে মনে হয়েছে ম্যুরসো কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছে। তার মধ্যে কোনো শোক বা দুঃখ বা কষ্টের কোনো ছায়াপাত ঘটেনি কান্না তো অনেক পরের কথা। ওয়ার্ডেনের মাধ্যমে জানতে পারে ম্যুরসোর বৃদ্ধা মা আশ্রমের টমাস পেরেজ নামে এক বৃদ্ধের সঙ্গে গভীর প্রেমে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে তাদের বিয়েও হতো।

ম্যুরসো ছুটি নিয়েছিল বৃহস্পতি ও শুক্রবার এবং শনি ও রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকাতে চার দিন সময় সে নিজের আস্তানায় ফিরে আসে এবং তার বান্ধবীর সঙ্গে থাকা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সবই এমন স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যেতে লাগল যেন তার জীবনে কিছুই ঘটেনি। অথচ তার মায়ের শোকে অন্যদের সান্ত্বনার বাণী তার কাছে অর্থহীন প্রলাপের মতো মনে হয়। শনিবার দিন বান্ধবী মারী কার্ডোনাকে নিয়ে সাঁতার কাটতে যায়, যায় সিনেমা দেখতে। মারী ম্যুরসোর প্রেমে গদগদ হয়ে সে জানতে চায় ম্যুরসো তাকে ভালোবাসে কি না। ম্যুরসো উত্তর দেয় ‘না’। আবার জানতে চায় মারীকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে কি না। ম্যুরসো উত্তর দেয়, করতে পারে। এমন নিরাসক্ত, জড়তুল্য ম্যুরসো যদিও মারীকে নিয়ে রাত্রিযাপন করে তবু কোনো কৃত্রিমতার আশ্রয় নিয়ে মারীকে প্রতারিত করতে চায়নি বা করেনি। বরং যা হতে পারে এমন কথাই সে বলে দেয় অকপটে। কারণ মারীই ম্যুরসোকে তার দিকে টেনেছে এবং যদি পরে বনিবনা না হয় তাহলে অন্যকে বিয়ে করতেই পারে এই নিরেট সততা ধারণ করে আবেগ অনুভূতিহীন ম্যুরসো। এ-রকম অনুভূতিহীনতার কারণেই মায়ের দেখভাল করতে পারবে না বলে মাকে আশ্রমে রেখে আসে। এজন্যও তার কোনো আক্ষেপ নেই।

ম্যুরসো যে এলাকায় থাকে সেখানকার পরিবেশ তখনকার সময়ের দারিদ্র্যপীড়িত, নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতার পরিচয় বহন করে। তার প্রতিবেশী বৃদ্ধ যার কুকুরকে সে ভালোবাসে কিন্তু সবসময়ও গালিগালাজও করে। মানুষ নিঃসঙ্গ হলে কারো না কারো সঙ্গ নিয়ে বাঁচতে চায়। কুকুরটি যেন তার নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র নির্ভরতা ছিল যেটি একদিন হারিয়ে যাওয়ার পর বৃদ্ধের করুণ আর্তি আর বিষাদ পাঠকের হৃদয় আর্দ্র করে। উপন্যাসটির মোড় নেয় যখন দেহোপজীবিনীদের দালাল হিসেবে পরিচিত খেতাদুরস্ত বেঁটে গাট্টাগোট্টা নিরক্ষর রেমন্ড সিন্তেসের সঙ্গে ম্যুরসোর দেখা হয়। তার সঙ্গেই পরিচয়ের পর প্রথমে সে পত্রলেখক হিসেবে পত্র লিখে দেয় এবং পরে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হয়। ঘটনাক্রমে রেমন্ডের সঙ্গে এক দেহোপজীবিনী মনোমালিন্য হলে তাকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এ নিয়ে মামলা হলে ম্যুরসো রেমন্ডের পক্ষে থানায় সাক্ষী দিলে অফিসার রেমন্ডকে ভর্ৎসনা করে বের করে দেয়। মামলাটি থানায় শেষ হলেও মেয়েটির ভাই রেমন্ডকে খুন করতে পিছু নেয়।

এক রবিবারে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ম্যুরসো, মারী ও রেমন্ড সমুদ্রতীরে যায় বেড়াতে। বাসস্টপে যাওয়ার আগেই রেমন্ড বুঝতে পারে সেই মেয়েটির ভাই এক আরব ছোকরা তাকে অনুসরণ করছে। সমুদ্রতীরে রেমন্ডের এক উদার প্রকৃতির বন্ধু ছিল। বন্ধুটির স্ত্রীও সে-রকম অতিথি-বৎসল্য। একটি উজ্জ্বল রোদের স্নিগ্ধ বাতাসের সকালে তাদের স্নানাহার বেশ জমে উঠেছিল এবং আনন্দে ভাসছিল। কিন্তু এই আনন্দ বিষাদে রূপ নেয় যখন আরব যুবকের হাতে চকচকে ছুড়ি দেখা গেল। রেমন্ড ভয়ে কাবু হয়ে গেলে ম্যুরসো রেমন্ডের পিস্তল নিয়ে প্রথমে একটি গুলি করার পর আরব যুবক লুটিয়ে পড়লে সে পরপর আরো চারটি গুলি করে। বলা যায় উপন্যাসটির প্রথম পর্ব এই খুন পর্যন্তই।

মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ম্যুরসো কারাগারের দিনগুলোতে দেখা যায় সে সব ব্যাপারেই অবিচিলিত, যা হওয়ার হবে তা নিয়ে ভাবার মতো কোনো মানসিকতা তার নেই।

দ্বিতীয় পর্বটি চলে ম্যুরসো বিচারের মধ্য দিয়ে। এই পর্বে বিচার কার্যটির নির্মাণে লেখকের অভিনব কৌশল ও তিনি যে অনেক বড় মাপের লেখক সেই দক্ষতার সুস্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। ম্যুরসো আবেগ অনুভূতিহীন এবং জীবনের প্রতি মায়াহীন আশ্চর্য এক চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন। তার বন্ধুরা এমনকি তার পক্ষের উকিলও ডিফেন্স করার জন্য কৌশলী উত্তর দেওয়ার জন্য তাকে বললেও সে যা ঘটেছে তাই বলেছে। সে খুন করেছে এ ব্যাপারে মিথ্যে বলেনি, একটি কথাও বানোয়াট বলেনি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তার সিদ্ধান্তে সে অকপট। সে আরব যুবককে চিনত না, বন্ধুকে রক্ষা করতে গিয়ে খুন করেছে। কেন খুন করেছিল এ কথা বিচারক জানতে চাইলে সে বলল, রোদের কারণে, সূর্যের উত্তপ্ত তাপের কারণে। এখানে সত্য-মিথ্যার একটি মিশেল রূপ দেখা যায়। সেদিন প্রখর উত্তাপ ছিল। এ-কারণে কি তার মাথা গরম ছিল—যা সে বলেছে। না কি বন্ধুকে রক্ষা করতে গিয়ে তাকে খুন করেছে। বিচারের খুঁটিনাটি বিষয় ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে সেই পূর্বের প্রসঙ্গই আসে যে, মায়ের মৃত্যুর পর এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় তার কোনো কষ্ট ছিল না এবং সে কাঁদেনি। ঘুরে ফিরে বারবার এই কথা এসেছে এবং সে নিজেও অকপটে স্বীকার করেছে। তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় মায়ের মৃত্যুর পর না কাঁদা ছিল প্রথা বিরোধী এবং এজন্য একজনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ারও বিধান ছিল। কামু বলেছেন, ‘In our society any man who doesn’t cry at his mother’s funeral he is liabl to be condemned to death. I simply meant that the hero of the book is condemned because he does not play the game. The answer is simple: he refuses to lie. Lying is not only saying what is not true… Meursault doesn’t want to make life simplier.’’

মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর কারাগারে ধর্মজাযককে পাঠানো হলো বিধি অনুসারে সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। কিন্তু ম্যুরসো নির্বিকার এবং পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেয় এসবের প্রয়োজন নেই। এতটা স্বাভাবিক যে মনে হয় মৃত্যুকে সে বরণ করার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে। ঈশ^রের পক্ষে পাদ্রী অনেক যুক্তি দেখালেও সে একই কথা বলেছে, এসবের প্রয়োজন নেই। মনক্ষুণ্ন হয়ে ফিরে যান পাদ্রি। শুধু ম্যুরসো কামনা করে তার মৃত্যুর সময় যেন অসংখ্য মানুষ দেখতে আসে আর তাকে ধিক্কার দেয়।

এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে কামু তাঁর অ্যাবসার্ড দর্শনের আলোকপাত করতে চেয়েছেন। অ্যাবসার্ডটিজম নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন যদিও এর পূর্ণাঙ্গতা নিয়ে সমালোচকদের মনে নানা রকম প্রশ্ন রয়েছে। এখানে দ্য মিথ অব সিসিফাসের সংশ্লিষ্টতাও দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। গ্রিক মাইথলজির সিসিফ চিরকাল একটি পাথর পাহাড়ের উপর দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে এবং সেই পাথরটা আবার গড়িয়ে নিচে পড়বে। এভাবে আজীবন চলতে থাকবে যাকে কামু অ্যাবসার্ড বলেছেন। অর্থহীন কাজ। পার্থিব জগতে এমন অ্যাবসার্ড অবস্থায় মানুষ হয়তো আত্মহননের পথ বেঁচে নিবে অথবা বিদ্রোহ করবে। অ্যাবসার্ড-এর (Absurd) ) বাংলা কয়েকটি প্রতিশব্দ পাওয়া যায়। যেমন, উদ্ভট, অযৌক্তিক, অর্থহীন, অসম্ভব, অদ্ভুত, হাস্যকর, ক্ষীণবুদ্ধি ইত্যাদি। জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে মানুষ নিজের অস্থিত্বকে মিলাতে পারে না, কিংবা মিলাতে চেষ্টা করে না তখন তার কাছে জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। জীবন যখন অর্থহীন তখন বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। আত্মহননও অনেক সময় এ-কারণে ঘটে। কামুর মতে আত্মহত্যা হলো অ্যাবসার্ডের স্বীকৃতি বা গ্রহণযোগ্যতা। অন্য কথায় বলা যায় পার্থিব বিষয়ে ব্যক্তির নিরাসক্তি এবং সত্য কিংবা মিথ্যা, স্বর্গ কিংবা নরক, বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের প্রতি অবিচলতাই হলো অ্যাবসার্ড। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ম্যুরসো কারাগারের দিনগুলোতে দেখা যায় সে সব ব্যাপারেই অবিচিলিত, যা হওয়ার হবে তা নিয়ে ভাবার মতো কোনো মানসিকতা তার নেই। অন্যদিকে পাদ্রীর আগমনে এবং তাঁর পরকাল সম্পর্কিত জ্ঞান তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। সব কথার উত্তরই সে দিয়েছে প্রয়োজন নেই বলে। এক্ষেত্রে ম্যুরসোর হরযরষরংস nihilism (the rejection of all religious and moral principles, in the belief that life is meaningless.) চূড়ান্তভাবে প্রকাশ পায়।

উপন্যাসের শেষে কামু কি শেষ পর্যন্ত ম্যুরসোর হৃদয়ে আক্ষেপের ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করলেন না কি অ্যাবসার্ডিজমের পথেই হাঁটলেন। উপন্যাসের শেষ প্যারায় এসে পাঠকের মন দ্রবীভূত হয় এবং পাঠক অনুসন্ধান করতে থাকে ম্যুরসোর ব্যক্তি, উদ্ভট আচরণ, নিরাসক্ত জীবনের হেঁয়ালিপনা এবং মৃত্যুর ঘণ্টা ধ্বনি বাজার আগে জীবনের সংঘাত কোথায়, সমাজ বাস্তবতার অমীমাসিংত সূক্ষ্ম মন্ত্রজাল কোথায় লুকিয়ে আছে। উপন্যাসটি শেষ হয় এভাবে, ‘অনেক কাল বাদে এই প্রথম আমার মনে হয় মা-র কথা মনে পড়ল। মনে হল কেন যে তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ভালবাসার লোক খুঁজেছিলেন, কেন যে জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করবার ছল করেছিলেন, এতদিনে বুঝলাম। যেখানে জীবনের সব দীপ কেবলই নিভে নিভে যাচ্ছে, সেই আশ্রমেও সন্ধ্যা আসে করুণ সান্ত্বনার মত। মৃত্যুর অত কাছে এসে, যেন স্বাধীনতার প্রান্তে এসে পৌঁছেছিলেন বলে মা-র মনে হয়েছিল। আবার যেন জীবন নতুন করে আরম্ভ করার সময় এসেছে। কারুর—পৃথিবীতে কারুর তাঁর জন্যে কাঁদার অধিকার নেই। আমারও মনে হচ্ছে যেন জীবনের নতুনযাত্রা শুরু করবার জন্যে আমি প্রস্তুত। ওই যে রাগে জ্বলে উঠেছিলাম তাতেই যেন আমাকে একেবারে নির্মল করে দিয়েছে, সব আশা আমার ভেতর থেকে শুষে নিয়েছে। রাত্রির তারার ইঙ্গিতভরা অন্ধকারের দিকে চেয়ে এই প্রথম সৃষ্টির প্রশান্ত ঔদাসীন্যের কাছে হৃদয় মুক্ত করে দিলাম। এ সৃষ্টির সঙ্গে আমার মিল খুঁজে পেয়ে তার সৌহার্দ্য অনুভব করে এই প্রথম বুঝলাম যে জীবনে আমি সুখীই ছিলাম। এখনও আমি সুখী। একটি আশা এখন শুধু রইল। তাহলেই সব কিছু পূর্ণ হয়। নিজেকে অত নিঃসঙ্গ আর তাহলে লাগবে না। শুধু যদি আমার মৃত্যুদণ্ডের সময়ে অনেক লোক আসে দেখতে আর চিৎকার করে গালাগাল দিয়ে যদি তারা আমায় অভ্যর্থনা জানায়।’

দ্য প্লেগ
মূল ফরাসি রচনা থেকে বঙ্গানুবাদ করেছেন দেবীপদ ভট্টাচার্য। পাঁচ পর্বে বিভক্ত দুই শতাধিক পৃষ্ঠার আঠাশটি পরিচ্ছদের উপন্যাসটি ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ডা. বার্নার রিও, সাংবাদিক রেমঁ রাঁবেয়ার, আগন্তুক তারু, স্থানীয় চিকিৎসক সমিতির সম্পাদক রিশার, ডা. রিও-এর স্ত্রী ও মা, ডা. কাস্তেল, চোরাকারবারী কোতার, সিটি কর্পোরেশনের কেরানী গ্রাঁ, ফাদার পানেলু… এবং আরো অনেক।

উপন্যাসের স্থানিক প্রেক্ষাপট আলজেরিয়ার বৃক্ষপল্লবহীন, পাখপাখালিবিহীন, ফাঁকা পথঘাটের শ্রীহীন নগরী ওরান। শহরটি কেবল গড়ে উঠছে তাই চারপাশেই শহরের জীবনের অপরিহার্য জিনিসের অভাব চোখে পড়ে। এখানকার মানুষেরা পরিশ্রমী, অভাবী। তাদের বিনোদনেরও তেমন সুযোগ নেই। উপন্যাসের স্থানিক প্রেক্ষাপট ওরান একটি ছোট্ট শহরের বর্ণনা এভাবে দেওয়া হয়েছে। একদিন ডা. রিও বাসা থেকে বের হয়ে সিঁড়ির চাতালে একটি ইঁদুর মারিয়ে যান। কোথা থেকে ইঁদুর এলো জানার জন্য কিছুটা অগ্রসর হয়েও তিনি ফিরে এসে দারোয়ান মিশেলকে প্রশ্ন করলে সে বলল, ইঁদুর থাকতেই পারে না। এই বাসায় ইঁদুর নেই। সারা দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাসার গেট খোলার সময় তিনি আরো একটি বেশ বড় ইঁদুর দেখলেন। এটি তার দিকে এগুতো গিয়ে হঠাৎই ওর মুখ থেকে রক্ত বের হয় মারা যায়। সকালের আর বিকেলের দুটি মৃত ইঁদুর দেখেন এবং ঘরে ত্রিশ বছরের স্ত্রী অসুস্থ যাকে পরের দিন হাওয়া বদলের জন্য দূরে একটি পাহাড়ে যাওয়ার কথা—এই দুটি ঘটনা তাঁকে চিন্তাচ্ছন্ন করে।

পরদিন মিশেল ডা. রিওকে নালিশ করেছে যে, পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা মরা ইঁদুর এখানে ফেলে গেছে যদিও রিও তা বিশ্বাস করেননি। মিশেল ইঁদুরের পা ধরে ঝুলিয়ে গেটের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল মজা করার জন্য। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হয়নি। তার মজা দেখার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। স্ত্রীকে পাহাড়ে পাঠিয়ে দেওয়ার পরের দিন ডা. রিওকে দেখভাল করার জন্য মা আসেন।

শহরের অন্যান্য মানুষও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াতে তাঁরা বিচ্ছেদের বিষাদের ছায়া পড়ে উপন্যাসের পাতায়।

হাসপাতালে যাওয়ার পর ইঁদুর মরার আরো খবর পাওয়া গেল। ইঁদুরগুলো মরে রাস্তায় পড়ে আছে। মানুষের মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়েছে ইঁদুর মরার খবর এবং সিটি কর্পোরেশন বিশেষ মনোযোগ দিয়ে ইঁদুর সরানোর কাজে নিয়োজিত হয়। কয়েকদিন পর দারোয়ান মিশেল জ্বরে আক্রান্ত হয়, কুচকি ফুলে যায়, শরীরে রেস ওঠে এবং দু-তিন দিন পরে মৃত্যুবরণ করে।

ডা. রিওয়ের দুশ্চিন্তা বেড়ে যায় এবং কেন এভাবে এত ইঁদুর মারা যাচ্ছে তার কারণ উদ্ঘাটন করার চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ইতোমধ্যে মিশেলের মতো অনেক মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ে যাদেরকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন। অন্য শহর থেকে আসা জ্যঁ তারু ঘটনা শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে ওরানে এসেছিলেন এবং লকডাউন হওয়াতে তিনি শহর থেকে বের হতে পারেননি। তাঁর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় তিনি হয়তো শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন এবং এজন্য শহরে সব স্প্যানিশ নর্তক ও গায়কের আড্ডায় তাঁকে ঘনঘন যাতায়াত করতে দেখা যেত। এই উপন্যাসের ডাক্তার রিওর পরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র জ্যঁ তারু। জ্যঁ তারু ঘটনার প্রথম থেকেই ডায়েরি লিখতেন যা ডা. রিওর জন্য বেশ কাজে দিয়েছিল। তবে ডা. রিও উপন্যাসের কথক, তাঁর ভাষায় এই ডায়রীতে তিনি বৈশিষ্ট্যহীন ঐতিহাসিক মূল্যহীন বিষয়গুলো লিখেছেন। তবে তাঁর ডায়রী থেকে ডা. রিও সঠিক তথ্য পেতেন।

কর্তৃপক্ষ প্রথমে প্লেগকে পাত্তাই দেয়নি এবং এটি বানোয়াট বা গুজব বিষয় বলে রিওর কথাকে উড়িয়ে দিত। পরে যখন মানুষের মাত্যুর হার বেড়ে গেল তখন শহরের ফটক বন্ধ করে দিলো। ‘ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বার্নার রিওর হাতে একখানি সরকারি টেলিগ্রাম তুলে দিলেন। ডাক্তার টেলিগ্রামে পড়লেন: প্লেগের মহামারীর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করুন। শহরের সমস্ত তোরণ বন্ধ করে বাইরের সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন করুন।’

এই রোগ যাতে না ছড়ায় সেজন্য যাবতীয় যোগাযোগ এমনকি পত্র যোগাযোগও বন্ধ করে দেওয়া হলো। তবে প্রভাবশালীরা প্রহরীদের সহায়তায় বাইরের মানুষের সঙ্গে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যোগাযোগ করতে পেরেছিল। প্রিয়জনদের কাছ থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। হয়ে গেল ঘরবন্দি। ‘শহরের ফটকগুলো বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে সকলে বুঝতে পারল যে তাঁরা সবাই একই অন্ধকূপে বন্দী হয়েছেন এবং সেইমত প্রথম থেকে নিজেদের তৈরি করতে হবে। … প্রিয়জনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার যে ব্যক্তিগত যন্ত্রণা তাতেও সকলে সমান অংশ নিতে লাগলেন এবং সামনে যে দীর্ঘ নির্বাসনের আশাঙ্কা তাও সকলের কাছে সমান ভয়ানক এবং কষ্টদায়ক বলে মনে হতে লাগল।’

কাহিনির চমকের জন্যই হয়তো বৃদ্ধ ডাক্তার কাস্তেল এবং সাংবাদিক রেমঁ রাঁবেয়ার স্ত্রীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছেন। লেখক নিরপেক্ষ ও আবেগহীনভাবে এই ঘটনার বর্ণনা করলেও পাঠকের মন ভারাক্রান্ত হয়। আবার গল্পের কথকের স্ত্রীও চিকিৎসার জন্য কোনো এক পাহাড়ে রয়েছে আর তিনি শ্রান্তিহীনভাবে প্লেগ রোগীর চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন ওরান শহরে। প্রেম-ভালোবাসা-আবেগ যেন কর্তব্য ও প্লেগের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাছে এক মহান যোদ্ধার কাছে গৌণ হয়ে যায়, হয়ে যায় অর্থহীন। শহরের অন্যান্য মানুষও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াতে তাঁরা বিচ্ছেদের বিষাদের ছায়া পড়ে উপন্যাসের পাতায়।

ওরান শহরের পথে-ঘাটে হাজার হাজার ইঁদুর মরে পড়ে থাকে আর হু হু করে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে চলে। সরকার প্রথমে আমলে না নিলেও শেষে আমলে নিয়ে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে। মানুষ আতঙ্কে ঘরবন্দি হয়ে দিন কাটাতে শুরু করে। শুরু হয় আইসোলেশন ও কোরায়েন্টাইন থাকতে বাধ্য করা। হাসপাতালে রোগীর স্থানের সংকুলান হচ্ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক দিনেই একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়।‘ঐদিন একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে সরকারিভাবে নতুন হাসপাতাল খোলা হলো। শহরের বাসিন্দারা এতদিন হাসি ঠাট্টার আড়ালে উদ্বেগ লুকিয়ে রেখেছিল, এবার কিন্তু পথে-ঘাটে তাদের নীরব বিষণ্ন মুখ অবস্থাটা স্পষ্ট করে তুলবে।’ শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নয়, শুল্কবিভাগের একটি বিল্ডিংয়েও অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। মৃতদের সৎকারের ব্যবস্থা করার জন্য শহরবাসীকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। এসব ঘটনা আমরা ২০২০ সালের করোনার মহামারীতেও দেখতে পাচ্ছি।

মহামারি বা মহাদুর্যোগের সময় অসাধু ব্যবসায়ীরা কালোবাজারি করে, মানুষকে ধোঁকা দিয়ে অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নেয়। প্লেগের সময় সে-রকম অসাধু ব্যবসায়ীদের নিষ্ঠুরতাও কথকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। এক সরাইখানার মালিক নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়, ‘ভালো মদ রোগের জীবাণু ধ্বংস করে।’ সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল মাদক পানীয় সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচায়। এই নোটিশের পর মদের বিক্রি বেড়ে যায়। বর্তমান সময়ের অর্থাৎ ২০২০ সালের করোনার মহমারীতে এ-রকম অনেক গুজবের খবর পাওয়া গেছে। ইরানে করোনা থেকে বাঁচতে অতিরিক্ত মদ্যপানে প্রায় তিন হাজার মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে অনেক গুজবের একটি ছিল থানকুনির পাতা খেলে করোনা হয় না। আর তখন মানুষ হিড়িক দিয়ে থানকুনির পাতা খাওয়া শুরু করে। কথকের কাহিনি থেকে এড়িয়ে যায়নি ফলস সার্টিফিকেটের ব্যাপারটি। রিওর কাছে ফসল সার্টিফিকেট নিতে এলে তিনি দেননি। একই রকম ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে যা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে দুটি প্রতিষ্ঠানের উৎকোচের বিনিময়ে নেগেটিভ সার্টিফিকেট প্রদানের ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে উভয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়।

বর্তমানের করোনা যদিও চীনে ডিসেম্বরে শুরু হয় কিন্তু পিক টাইম এপ্রিল বলা যায় যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং অক্টোবরে টিকা পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

বিড়াল পালিয়ে গেছে এবং সারা শহরে যেন প্লেগের বাহক ইঁদুরের রাজত্বই চলছে আর মানুষ নিধন করে গেছে। গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, ‘প্লেগের সময় বিড়ালের গায়ে থুথু ফেলা বারণ।’ এ-রকম গুজব যেন বাস্তবতারই অনুনাদ। নিরুপায় মানুষের শেষ আশ্রয় সৃষ্টিকর্তা। ওরান শহরের ধর্মাধিকরণ প্লেগের মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সপ্তাহব্যাপী সর্বজনীন প্রার্থনার আয়োজন করে। করোনাকালেও বিভিন্ন দেশে এমন সর্বজনীন প্রার্থনা দেখা গেছে। এই উপন্যাসে ফাদার পানেলু গুরুত্বপূর্ণ স্থান জুড়ে আছেন। তিনি প্রচার করতে লাগলেন যে, এই মহামারী পাপের ফল এবং তিনি বাইবেল থেকে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে মানুষকে বোঝাতেন। ঈশ^রের যারা শত্রু তাদের ওপর এই আঘাত। ওরানের লোকজন ধর্মপ্রাণ এ-কথার কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু ধর্মপ্রাণ না হলেও মহামারীকালে গির্জায় মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। এক সময় একটি শিশু মারা যাওয়াতে তার কী পাপ ছিল সে প্রশ্নের মুখে পড়ে পানেলু সদুত্তর দিতে পারেননি। বর্তমান সময়ের করোনাকালে বাংলাদেশের অনেক ধার্মিক ব্যক্তিও প্রচার করেছেন যে, বিধর্মীদের জন্য এই রোগ। কোনো মুসলমানের এই রোগ হতে পারে না। কিন্তু পরে যখন ইসলামী দেশগুলোতে মহামারী দেখা দিল তখন এই ধার্মিকদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। গীর্জায় যদিও মানুষের ভিড় ছিল কিন্তু করোনাকালে প্রথমে প্রার্থনালয় বন্ধ এবং কয়েক মাস পরে সীমিত আকারে স্বাস্থবিধি মেনে প্রার্থনালয় খুলে দেওয়া হয়েছে। পানেলও মৃত্যুবরণ করেন কিন্তু তিনি প্লেগে মারা যাননি। পানেলুর স্বাভাবিক মৃত্যু দিয়ে নিরপেক্ষতার প্রমাণ করেছেন লেখখ। অন্যথায় হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারত লেখক ইচ্ছে করেই ধর্ম বিদ্বেষ থেকে পানেলুর মৃত্যু প্লেগের কারণে ঘটিয়েছেন।

কথকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি যে, সরকারি পদধারী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয়, বীমা, বাণিজ্য, ব্যাংক ইত্যাদি নানা রকম সুবিধাজনক কাজে ব্যস্ত থাকলেও প্লেগের ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞান ছিল না এবং এ ব্যাপারে তারা মাথাও ঘামাত না। এই চিত্র বর্তমানের করোনাকালে বিভিন্ন দেশে যেন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। পক্ষান্তরে, মানুষের মনোভাব ও কার্যকলাপ দেখে সাংবাদিক রাঁবেয়ার ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং কর্তৃপক্ষের কারণে সত্য প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। মহামারীর বলি বা দুর্যোগই বলি এ-কথা চিরন্তন সত্য যে, এই মানবিক মানুষেরা যেমন জীবন বাজি রেখে কাজ করে ঠিক তেমনি দুর্বৃত্তরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকে না। তারাও পেরোয়াভাবে দুর্নীতির সংঘবদ্ধ চক্রে জড়িয়ে যায়। প্লেগ উপন্যাসেও কামুর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি এমন এক চোরাকারবারী কোতারের চরিত্রটি। ভদ্রবেশী কোতার মদ ও সিগারেটের চোরাচালানে লিপ্ত হয়ে অর্থ উপার্জনে লেগে যায়। যদিও শেষ পর্যন্ত তার পরিণতি ভালো হয়নি। শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।

আরেকটি লক্ষণীয় দিক হলো শহরের ফটক বন্ধ হলে মানুষ শহর থেকে বের হওয়ার জন্য নানা রকম ছলছাতুরির আশ্রয় নিয়েছিল। ঠিক এই দৃশ্য আমরাও দেখেছি নানা কৌশলে মানুষ ঢাকা শহর থেকে বের হয়ে গেছে অথবা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মালামাল পরিবহনের ট্রাকে করে পলিথিন মুড়িয়ে শহরে এসেছে অথবা শহর ছেড়েছে।

তারু স্বাস্থ্যসেবকদের নিয়ে ‘স্বাস্থ্যসংরক্ষণ বাহিনী’ নামে সংগঠন করে, ডাক্তার রিও চিকিৎসা উদ্ভাবনের বাঁচামরা লড়াইয়ে অবিশ্রাম লড়ে যায় এবং সাংবাদিক রাঁবেয়ার সংবাদ সংগ্রহের জন্য দিন রাত্রি খেটে চলছে, নিরাপত্তাকর্মীরা শহরের নিরাপত্তার জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছে—কী অসাধারণ মিল আমরা খুঁজে পাই বর্তমান করোনা মহামারীতে। সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে বর্তমান সময়েও এই চার শ্রেণির মানুষকেই দেখা যাচ্ছে জীবন বাজি রেখে করোনাকে মোকাবিলা করে যাচ্ছে। ডা. রিও এক সময় মনে করলেন, রোগীকে বাঁচানোর জন্য প্লাজমা থেরাপি প্রয়োজন এবং তিনি প্লাজমা থেরাপিও দিতে শুরু করলেন যদিও তাতে কাজ হয়নি। করোনা চিকিৎসাতে প্লাজমা থেরাপির আলোচনা একবার বেশ জোরেসোরেই উঠেছিল যদিও শেষের দিকে এই বিষয়টি নিয়ে আর আলোচনা শোনা যায়নি।

করোনার মহামারীতে যেসব দৃশ্য আমাদের দৃষ্টিতে এসেছে সেইসব দৃশ্যও এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। বর্তমান সময়ের পাঠকের কাছে মনে হতে পারে সবকিছুই যেন চোখের সামনে ঘটছে। ‘প্রার্থনা চলতে চলতেই কফিনটাকে গাড়ী থেকে নামিয়ে দড়ি বেঁধে কবরের পাশে টেনে আনা হতো, তারপর দড়ি টেনে খুলে ফেলবার সঙ্গে সঙ্গে ভারী বাক্সটা সশব্দে গর্তের তলায় গিয়ে পড়ত। … ইতোমধ্যে জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে ধুয়ে ফেলার জন্যে অ্যাম্বুলেন্সটাকে সরিয়ে ফেলা হতো আর এদিকে খন্তাভর্তি মাটি বারবার কবরে মাটি পড়তে থাকার মধ্যেই মৃতের আত্মীয়েরা ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠতেন।’

শুধু তাই নয়, মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নারী-পুরুষের মৃতদেহগুলো অশালীনভাবে স্তূপীকৃত হতো। এ-রকম ঘটনা কি করোনাকালে পৃথিবীর কোনো দেশে ঘটেনি? ঘটেছে বলে প্রমাণও পাওয়া যায়। উপন্যাসের শেষে এসে ডা. কাস্তেল টিকা আবিষ্কার করে মানুষের শরীরে ব্যবহার করেন। খুব অবাক করা একটি মিল খুঁজে পাওয়া সময়ের হিসেবেও—প্লেগ শুরু হয়েছিল এপ্রিলে এবং অক্টোবরে এসে টিকা আবিষ্কৃত হয়। বর্তমানের করোনা যদিও চীনে ডিসেম্বরে শুরু হয় কিন্তু পিক টাইম এপ্রিল বলা যায় যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং অক্টোবরে টিকা পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

উপন্যাস জুড়ে তারুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করে যে নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়ে প্লেগ মোকাবিলা করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আনার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে সেই তারু শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারেনি। ডা. রিও ও তাঁর মায়ের অক্লান্ত বিরামহীন শুশ্রূষা দিয়েও তারু জীবন রক্ষা করতে পারেননি ; প্লেগ কেড়ে নেয় তার জীবন। কর্তব্য পরায়ণ দুর্দান্ত সাহসী ও কঠোর পরিশ্রমী নিজের স্ত্রীর কথা ভুলে যান, সংসারের মায়া ত্যাগ করে এক অকুতোভয় সৈনিক হয়ে শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত রাত দিন চষে বেরিয়ে রোগীর চিকিৎসা, গবেষণা, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজ করে গেছে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু এই ত্যাগী মানুষটির জীবনেও কষ্টের সংবাদ বয়ে আসে যে, ডা. রিওর ত্রিশ বছরের স্ত্রী মারা যান।

মহামারীতে প্রেম ভালোবাসা সামায়িকভাবে বিষাদের রূপ নিলেও মানুষ সুযোগ পেলেও প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করে। কঠিন দুর্যোগের সময়ও এমন নজির দেখা যায়। যুদ্ধ শিবিরেও বিয়ে হওয়ার ঘটনাও থেমে থাকে না। করোনা মহামারীতেও বিভিন্ন দেশে প্রেম ও বিয়ের ঘ্টনাও কিন্তু কম ঘটেনি। মাস্ক পরে প্রেমিক-প্রেমিকার চুম্বনের দৃশ্য সোস্যাল মিডিয়াতে প্রায়ই দেখা গেছে। প্লেগের সময় মাস্কের বিধান না থাকলেও প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেমের শাশ্বত রূপ প্রকাশ পায়। বহুদিন আটকে পড়া সাংবাদিক রাঁবেয়ার ফটক খুলে দেওয়ার প্রিয়তমের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছেন। বৃদ্ধ কাস্তেলও স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পেরেছেন।

কাহিনি বা ঘটনা ভিন্নভাবে সাজানো হলেও দ্য প্লেগের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, চিকিৎসা, প্রশাসনিক ইত্যাদি ঘটনাবলি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

শহরে বিড়ালের উপস্থিতি দেখা যায়, ‘শেষ পর্যন্ত শহরের জনসাধারণ, সংবাদপত্র, রেডিও আর প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের উচ্ছ্বসিত অভিনন্দনের মাঝে ফেব্রুয়ারির এক সুন্দর সকালে শহরের তোরণ খুলে দেওয়া হলো। এখন এই কাহিনীকারের কর্তব্যের মধ্যে বাকি রইল ফটক খোলার পর জনসাধারণের আনন্দের একটা বিবরণ দেওয়া-যদিও তাঁর নিজের এই আনন্দে পুরোপুরি অংশ নেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না।’

উপন্যাসটি শেষ হয় এভাবে, ‘শহর থেকে প্রবাহিত উল্লাসের শব্দ শুনতে শুনতে ডাক্তার উপলব্ধি করলেন যে, এই উল্লাস সব সময়ই আসন্ন বিপদের সম্ভাবনা পঙ্গু, কারণ এই উল্লসিত জনতা যে সত্য জানে না তিনি নিজে তা জানেন। তিনি বই পড়ে জেনেছেন যে মৃত্যুবাহী রোগের বীজ কোনদিন মরে না, কোনদিন একেবারে অন্তর্হিতও হয় না ; তিনি জানেন যে যুগ যুগ ধরে এ-বীজ সুপ্ত অবস্থায় আসবার আর বিছানাপত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, জানেন যে তারা অসীম ধৈর্য নিয়ে মানুষের ঘরে, নিচের চোরকুটুরিতে, তোরঙ্গের মধ্যে রুমালে, আর বইয়ের আলমারি তাকে তাকে অপেক্ষা করে,- তিনি জানেন হয়তো আবার এমন দিন আসবে যখন দুর্ভাগা মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্য মারী আবার ঘুম থেকে জেগে উঠে তার বাহন ইঁদুরগুলোকে জাগিয়ে তুলে আবার কোন আনন্দমুখর শহরের পথেঘাটে মরতে পাঠাবে।’

দ্য প্লেগ প্রতীকধর্মী উপন্যাস। এই উপন্যাসে রোগব্যাধি, জরা, মৃত্যু, অবিচার, অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েকজন নিষ্ঠাবান পরিশ্রমী যোদ্ধার অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামের চিত্র দেখতে পাই। স্বৈরাতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবের বিকল্প নেই। এই বিপ্লব ছিল মানুষের উত্থানের, বেঁচে থাকার, শান্তির এবং গণতন্ত্রের। মানুষের সম্মিলিত শক্তির কাছে যে প্লেগ হার মানে তাই কামু দেখিয়েছেন। মহামারী থেকে বাঁচার জন্য একার প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়, যেমন সম্ভব নয় অন্যায় ও অবিচারে মন্ত্রজালে আবৃত কোনো সমাজকে শোষণমুক্ত করা। মানুষের সৃষ্টি কিংবা প্রাকৃতিকভাবে মহামারীর মতো দুর্যোগ পৃথিবীতে বারবার আসবে কিন্তু তাকে প্রতিহত করার জন্য ডা. রিও, তারু, রাঁবেয়ার, ডা. কাস্তেল, রিওর মায়ের মতো আত্মত্যাগী, সংগ্রামী, সাহসী মানুষের বিপ্লব প্রয়োজন। অবরুদ্ধ ও শৃঙ্খলিত সমাজের বিপ্লব ছাড়া মুক্তির নেই।

উপসংহারে কিছু কথা বলা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। কামুর দ্য প্লেগ বিশ^ব্যাপী একটি এলিগরি বা রূপকাশ্রয়ী বা প্রতীকাশ্রয়ী উপন্যাস হিসেবে সুপরিচিত ও বিবেচিত। এই উপন্যাস নিয়ে যত প্রবন্ধ ও আলোচনা-সমালোচনা পড়েছি সবগুলোতেই বিদগ্ধ সাহিত্যিকগণ এলিগরি উপন্যাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। প্লেগকে জামানির নাৎসী বাহিনীকে রূপক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে এবং ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহতম নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসের দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে নাৎসী বাহিনী যেভাবে আক্রমণ করেছে প্লেগ যেন ঠিক তারই ভার্সন। প্লেগের চেয়ে ভয়ঙ্কর নাৎসী বাহিনী। নাৎসী বাহিনী এক সময় পরাভূত হয় অন্যান্য দেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেভাবে ডা. রিও, রাঁবেয়া এবং তারুর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর পর প্লেগকে রুখে দিতে পেরেছে। কিন্তু এরপরও কথক উপন্যাসের শেষে বলেছেন এই মৃত্যুবাহী রোগের বীজ কখনো ধ্বংস হবার নয়। এই কথার প্রমাণ আমরা পেয়ে যাচ্ছি প্রতি নিয়তই। মধ্য প্রাচ্যের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞসহ ছোটখাটো যুদ্ধ বিগ্রহ পৃথিবীতে লেগেই আছে। প্লেগের জীবাণু মরেনি। মরবে না।

উপন্যাসটি বাস্তবতার আঙ্গিকে এলিগরি ক্যাটাগরিতে মর্যাদা পেয়েছে বিশ^সাহিত্যে। এ নিয়ে আর কোনো কথা থাকতে পারে না। কিন্তু বর্তমান লেখকের মনে দ্য প্লেগ পাঠ ও প্রবন্ধ লেখার পরে কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যেগুলোর উত্তর জানা নেই। এই প্রশ্নগুলো পাঠকের জন্য রাখা হলো এবং তাঁরা যদি পারেন উত্তর অনুসন্ধান করবেন। যদি এই উপন্যাসকে এলিগরির ক্যাটাগরিতে না ফেলে সম্পূর্ণ বাস্তবভিত্তিক সার্থক শিল্পিত উপন্যাস হিসেবে মহামারীর একটি নিখুঁত দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় তাহলে কি অতিশয় ভুল হবে? এই প্রবন্ধে উপন্যাসের কিছু কিছু অংশ উদ্ধৃত করে ২০২০ সালের নভেল করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগের কারণে যে মহামারী চলছে এর ঘটনার সঙ্গে একটি যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখে বাস্তবতাকে যাচাই করার জন্য। এই শতাব্দীর কোভিড-১৯ মহামারীর যেসব ঘটনা ঘটছে তার একই রূপ দ্য প্লেগ উপন্যাসের শিল্পে উপস্থাপিত হয়েছে। এখন যদি কোনো ঔপনাসিক কোভিড-১৯ নিয়ে কোনো উপন্যাস লিখেন তাহলে এটিকে কি এলিগরির ক্যাটাগরিতে ফেলা হবে যে নাৎসি বাহিনী আবার ফিরে এসেছে? কাহিনি বা ঘটনা ভিন্নভাবে সাজানো হলেও দ্য প্লেগের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, চিকিৎসা, প্রশাসনিক ইত্যাদি ঘটনাবলি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *