দ্বিতীয় দিনের কাহিনী : সৈয়দ শামসুল হক

দ্বিতীয় দিনের কাহিনী : সৈয়দ শামসুল হক

 

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর আর কোনো সাহিত্যিক নেই যাঁর সৃষ্টির বৈচিত্র্য, প্রাচুর্য ও ঐশ^র্য সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে তুল্য, বাংলাদেশে তো নয়ই। বুদ্ধদেব বসুকে রবীন্দ্রযুগের পরবর্তী বহুমাত্রিক লেখক হিসেবে বলা হলেও সৈয়দ শামসুল হকের ব্যাপ্তি অনেক বেশি। তিনি একমাত্র সাহিত্যিক যিনি উপন্যাস, নাটক, গীতিনাট্য, কবিতা, গান, গল্প, ছড়া, প্রবন্ধ, চিত্রনাট্য অর্থাৎ সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি কৃতিত্বের ছাপ রাখেননি। প্রতিটি শাখায় লিখেছেন দুহাত ভরে। সৃষ্টি তো কম নয়; বিপুল; তাঁর রচনাসমগ্র চল্লিশ খন্ড ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এই বিপুল সাহিত্যসম্ভার সৃষ্টি করলেও তিনি বাংলাদেশ ছাড়া বাংলা ভাষাভাষী ভারতের পশ্চিম বঙ্গে কিংবা অন্য কোনো প্রদেশে পরিচিতি ও পাঠকপ্রিয়তা পাননি, অথচ পশ্চিমবঙ্গের অনেক লেখক এদেশের পাঠকের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। রহস্যময়!

এই বহুমাত্রিক লেখকের গ্রন্থাদির তালিকা দীর্ঘ হওয়াতে এখানে উল্লেখ করা হয়নি। তবে তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যেসব উপন্যাস লিখেছেন তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘জনক ও কালোকফি’, ‘নীল দংশন’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনি’, ‘ত্রাহি’ ও ‘অন্তর্গত’ ইত্যাদি। দ্বিতীয় দিনের কাহিনি ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়।

 

অধ্যায় ও অনুচ্ছেদহীন (প্যারাগ্রাফ) টানা ১২০ পৃষ্ঠার নাতিদীর্ঘ উপন্যাস ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’র কেন্দ্রীয় চরিত্র তাহেরউদ্দীন খন্দকার, জলেশ^রী স্কুলের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, জলেশ্বরীতে যাওয়ার প্রাক্কালে উত্তরবঙ্গের কোনো এক রেলস্টেশন নামার পর থেকে গল্পটি ধীর লয়ে এগিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধোত্তর এই উপন্যাসে আখ্যানের শাখাপ্রশাখা নেই, কয়েকটি চরিত্রের গ্রন্থিত শাখাপ্রশাখাহীন একটি সরল গল্প। উত্তর-স্বাধীনতা বাংলাদেশে নানা রকম সংকট যেমন- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছিল দেশের মানুষ। স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন ও নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে তখনকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের ভয়াবহতা আঁচ করা যায়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের স্বাধীনতার পর ওই ধরনের সংকট অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ওই সংকটকে সমাধানের জন্য না এগিয়ে এক শ্রেণির মানুষ বরং আগুনে হাওয়া দিতে শুরু করেছিল। স্বভাবতই, স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি যদিও ঘাপটি মেরে ছিল তথাপি তারা তৎকালীন সরকারের পতনের জন্য নিস্ক্রিয় ছিল না। পক্ষান্তরে, বাহাত্তর সালে জাসদের গণবাহিনী, সর্বহারা পার্টিসহ আরও কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি ক্ষমতা দখল করার লোভে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের জন্য সারা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক দলগুলোর নৈরাজ্য সৃষ্টির সুযোগে চোর-ডাকাতরাও সেই সুযোগটি গ্রহণ করে চুরি-ডাকাতি-খুন করে সর্বহারা পার্টির নামে চালিয়ে দিত। অনেক মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র জমা দেননি, ফলে অনেকের হাতেই অস্ত্র ছিল যা দিয়ে অবৈধ কাজ করতে তারা সক্ষম ছিলেন। পরিষ্কারভাবে বলতে হয় যে, সাতচল্লিশের পর, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে কখনও ক্ষমতা পায়নি এদেশের কোনো নেতা। তারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে কলোনি হিসেবে মনে করত এবং পাকিস্তানের ব্যাপক উন্নতি হলেও এদেশে ভালো একটি রাস্তাও পর্যন্ত নির্মিত হয়নি। এমনিতেই এদেশের মানুষ ধর্মান্ধতার কারণে শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে ছিল; উপর্যুপরি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীদের শোষণ ও হঠকারিতার কারণে এদেশের মানুষ প্রশাসনেও উচ্চতর পদপদবি পায়নি। ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, প্রশাসনেও মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে সব অফিস আদালত শুরু করতে হয়েছে। মেজররা হয়ে গেছেন জেনারেল, সাধারণ কেরানি হয়ে গেছেন ম্যানেজার, এমডি ইত্যাদি। এটি একটি উদাহরণ। এরপরই শুরু হয় চুয়াত্তরের বন্যা এবং বন্যার পর দুর্ভিক্ষ। বঙ্গবন্ধুর সরকার ভারত ও রাশিয়ার দিকে ঝোঁক থাকাতে বৈদেশিক সাহায্যের পরিবর্তে ছিল ষড়যন্ত্রের কঠিন জাল। দেশের এই ধরনের ক্রান্তিকালে পটভূমিতে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’। এই উপন্যাসের পটভূমি উত্তরবঙ্গের লেখকের কল্পভূমি বা কল্পিত জনপদ ‘জলেশ^রী’। জলেশ্বরীর পটভূমিকে ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ লেখক যে রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্র এঁকেছেন তা ছিল সেই সময়কার সারা বাংলাদেশের নিরেট বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ উপন্যাসটির নির্মাণ প্রচলিত ধারার নয়। সৈয়দ হক এই উপন্যাসে প্রত্যক্ষ কোনো সংলাপ বা উদ্ধৃতি ব্যবহার না করে পরোক্ষ সংলাপ প্রয়োগের ফলে সম্পূর্ণ আখ্যানটি প্রমিত ভাষায় রচিত হয়েছে। উপন্যাসের কোনো অংশে চেতনাপ্রবাহ রীতি অনুসরণ করা হলেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসের মতো একছত্র প্রাধান্য বিস্তার করেনি। বলাবাহুল্য যে, সৈয়দ হকের ভাষা সরল বা তরল নয়, আবার দুর্ভেদ্যও নয়। তাঁর নিজস্ব ভাষা ভঙ্গিমা, এবং সরল, জটিল ও যৌগিক বাক্য বা দীর্ঘ বাক্য গঠন রীতিই এই উপন্যাসেও প্রয়োগ হয়েছে। এটি বক্তব্য-প্রধান উপন্যাস বলে সংলাপের অতিরঞ্জন এই উপন্যাসে নেই। খুব প্রাসঙ্গিক ও অল্প সংলাপের ভিত্তিতে উপন্যাসটি নির্মিত হয়েছে। চরিত্রের চেয়ে পারিপার্শিক অবস্থা অর্থাৎ পটভূমি এবং নৈসর্গিক বর্ণনায় চমৎকারিত্ব রয়েছে।

উপন্যাসের প্রথম কয়েকটি বাক্যেই একটি ভাবগম্ভীর পরিবেশের আভাস পাওয়া যায়, রহস্যময় জালে পাঠক আটকে যায় এবং এটি সরল ভাষার হালকা আমেজের কোনো উপন্যাস নয় সে বার্তাও পাওয়া যায়। প্রথম বাক্য পাঠের পরেই পাঠকও গুরুগম্ভীর উপন্যাস পাঠের প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হন।

সারা দিন অত্যন্ত মন্থর কেটে যাবার পর আচমকা রাত নামে, কেননা দিনের ভেতরে স্মৃতি রচিত হবার অবকাশ সম্ভবত নেই। প্রথমে বিশাল একজোড়া ডানার মতো ছায়াপাত সমস্ত বস্তু এবং অস্তিত্বের ওপর অনুভব করা যায়; পরে, রোদের ভেতরে সারা দিন বিভিন্ন উৎস থেকে বেরিয়ে এসে শব্দগুলো যে স্তব্ধতাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল অদৃশ পঙ্গপাল যেন বা, তারা ক্ষান্ত হয়। এখন স্তব্ধতা আবার তার অলৌকিক ফলের মতো ক্লান্তি ফিরে পায়; রাত গভীরতর হয়; স্তব্ধতা, পূর্ণতর। তাহের তার গন্তব্য জলেশ্বরীতে এসে পৌঁছায়। মুমূর্ষ ব্যক্তির মতো রেলগাড়ি সংক্ষিপ্ত একটি আর্তধ্বনি তুলে নিস্পন্দ হয়ে যায়; এরপর আর কোনো ইস্টিশন নেই; এখান থেকে গাড়ি আবার উল্টো দিকে যাত্রা করবে। দ্বিতীয় দিনের কাহিনী, পৃষ্ঠা ৭।

যদিও তাহেরই এই উপন্যাসের প্রধান বা কেন্দ্রীয় চরিত্র তথাপি জলেশ্বরী জনপদে অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে প্রভাবশালী চরিত্র হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন যার পিতৃপ্রদত্ত নাম মজহার। ক্যাপ্টেনকে কেন্দ্র করেই ওখানকার গল্পটা আবতির্ত হয়েছে।

উত্তর-স্বাধীনতা বিহারি অধ্যুষিত এলাকার পরিবেশ দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে ভিন্নরকম ছিল। প্রসঙ্গক্রমে, বাংলাদেশ ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও বিহারি অধ্যুষিত ঢাকার মিরপুর বিহারিদের কব্জায় ছিল ১৯৭২ সালের ৩০ শে জানুয়ারি পর্যন্ত। ওই এলাকা ওই বছরের ৩১শে জানুয়ারি সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। একই কারণে, স্বাধীনতার পরেও রংপুরের সৈয়দপুর বিহারি অধ্যুষিত এলাকায় হওয়াতে সেই এলাকাটিও বিভিন্নভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সেখানে বিহারিদের প্রতি মুক্তিযোদ্ধা বা বিহারি দ্বারা নির্যাতিত জনগণের প্রবল রোষ থাকার কারণে উভয়পক্ষের মধ্যে দাঙ্গা হওয়ার আশঙ্কা ছিল। আলোচ্য উপন্যাসে, লেখক অত্যন্ত যত্ন সহকারে তৎকালীন সময় ও মানুষের মনোভাব ও আচরণকে ধারণ করেছেন। জলেশ্বরী স্টেশনের থমথমে পরিবেশ যেন এই অবস্থারই নির্দেশক।

তাহেরউদ্দিন খন্দকার বাকশোপেটারা নিয়ে ঢাকা থেকে একটি স্কুলের হেড মাস্টারের পদে যোগদান করতে গিয়ে স্টেশনে নামার পর তাকে ঘিরে সন্দেহ ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে বিহারিদের সন্দেহ এবং অন্য দিকে ক্যাপ্টেন মজহার বাহিনীর সন্দেহ। তাহেরকে ঘিরে জনতার ঔৎসুক্য দেখে সে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিত হয়। তারপর স্টেশনের প্ল্যাটফরমেই ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা হলে সে যে এই এলাকার প্রতাপশালী এবং এছত্র আধিপত্যবিস্তারকারী যাকে মহকুমা হাকিমও তোয়াজ করে এই বিষয়টি তাহেরকে বোঝানো হয়। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের কিছু বিষয় উৎকীর্ণ হয়। একটি সড়কের নাম কেন শহীদ বরকতউল্লাহ ও শহীদ আনোয়ার হোসেন রোড করা হয়েছে এই বার্তাও ক্যাপ্টেন তাকে দেয়।

জলেশ্বরী রেলস্টেশন থেকে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছা পর্যন্ত উপন্যাসের প্রায় মাঝামাঝি পর্যায়ে চলে যায়। লেখকের নির্মাণ কৌশল ও নৈপুণ্যের বদৌলতে এই আখ্যানটি এভাবে গড়িয়েছে। স্টেশন থেকে হোটেলে রাত্রিবাসের জন্য ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে ক্যাপ্টেনের ক্ষমতাও প্রদর্শিত হয়েছে মালিককে থাপ্পড় মারার মধ্য দিয়ে। চেতনাপ্রবাহে গল্পের ভেতরে ঢুকে গেছে আরও গল্প। প্রতিটি গল্পই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। মৃতদার তাহের মূলত নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে ঢাকা ছেড়ে ছেড়ে দূরের স্কুলে, বাবার চাকরির সূত্রে যেখানে তার জন্ম ও থাকা হয়েছিল বহু বছর আগে, সেখানকার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছে। স্কুলের পথে যেতে যেতেই তার পুরোনো স্মৃতির জাহাজ নোঙর ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক বাস্তব ঘটনার পাশাপাশি তার স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রীর করুণ মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনাও স্মৃতি থেকে পাওয়া যায় :

তবে, স্ত্রীর কথা মনে পড়ে, সেটা মনে পড়ে দূর থেকে দেখা ছবির মতে, স্থির একটা ছবির মতো, ব্যক্তিগত একটা সম্পত্তির মতো। ঢাকায়, তার বাসায় মিলিটারি এসেছিল, যে ইস্কুলে সে শিক্ষকতা করত সেখানে বাংলাদেশের পতাকা কেন ওড়ানো হয়েছিল, কারা উড়িয়েছিল, সে বিষয়ে প্রশ্ন করতে। কিন্তু অচিরেই বেপথু হয়, তারা আকৃষ্ট হয় স্ত্রীর দিকে, অথবা, যেহেতু তারা ধারণা করেছিল, সে সত্য কথা বলছে না, তাই চাপ সৃষ্টি করবার জন্যে মনোযোগ দিয়েছিল তার স্ত্রীর দিকে। অচিরেই, তার স্ত্রীকে তারা ধর্ষণ করে এবং বাসা থেকে পালাবার চেষ্টা করবে না জাতীয় ধমক দিয়ে চলে যায়। স্ত্রীর জন্যে সে তখন ওষুধ আনতে বেরোয়, এবং ঘণ্টা দুয়েক পরে ওষুধ কোথাও না পেয়ে বাসায় ফিরে দেখে, স্ত্রী ছাদে বিজলি-পাখার আংটা থেকে পরনের শাড়ি গলায় ঝুলে আছে। পৃষ্ঠা ৩৬

যুদ্ধ বিধ্বস্ত পুরোনো স্কুল, যার পঁচিশ বছরেও কোনো সংস্কার হয়নি যেন বা দাঁড়িয়ে আছে একটি ন্যায়, সত্য ও আলোঘরের প্রতীক হয়ে। ভেঙে পড়া এই সত্য ও ন্যায়ের মাঝি স্কুলের হেড মাস্টার তাহের। তাহের ও স্কুলকেই ঘিরেই মূলত উপন্যাসের গল্পটি আবর্তিত হয় এবং অধিকাংশে ক্ষেত্রে তাহেরের জবানিতে, স্বগতোক্তিতে মুক্তিযুদ্ধ ও তখনকার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের হালচাল বর্ণিত হয়। মফস্বলের স্কুল বলে সেখানে পর নিজের থাকার জায়গা নিয়ে ভাবিত হলে দপ্তরি পরাণ অফিসকক্ষটিকে থাকার জন্য ব্যবহার করতে বললে তাহের দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং শেষাবধি অন্য কোনো উপায় না পেয়ে ওই কক্ষে নিজের থাকার ব্যবস্থা করে এবং খাওয়ার জন্য পেয়িং গেস্ট হিসেবে পরাণের পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হয়। পরাণ ও তার স্ত্রী সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে হেড মাস্টার তাহেরের খাবারের ব্যবস্থা করে। এতে ওদেরও কিছুটা আর্থিক সুবিধা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামপন্থি দলগুলোসহ প্রায় সব মওলানাই ছিল স্বাধীনতার চরম বিরোধী। প্রায় সব স্কুলের মওলানা শিক্ষকরাও এই দলভুক্ত ছিল যার প্রমাণ বর্তমান লেখকের অভিজ্ঞতাসহ বিভিন্ন মাধ্যমেও পাওয়া যায়। জলেশ্বরী স্কুলের মওলানাও এই কর্মকা- থেকে মুক্ত ছিল না। তাঁর নির্দেশে এগারো জন মানুষকে স্কুলে হত্যা করা হয়েছিল, যাদের রক্তের দাগ দেওয়ালের বিভিন্ন জায়গায় এখনো বর্তমান পরাণ তাহেরকে দেখায়। অনস্বীকার্য যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে মাদরাসাই ছিল পাকিস্তানি মিলিটারি ও রাজাকারদের ক্যাম্প। জলেশ্বরী স্কুলটিও এই কলঙ্ক থেকে মুক্ত ছিল না।

যুদ্ধোত্তর এদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও ছিল নাজুক অবস্থা। অনেক স্কুল-কলেজের ফার্নিচারসহ মূল্যবান সামগ্রী চুরি বা লুট হয়েছিল, অনেক প্রতিষ্ঠানে পাকসেনা ও রাজাকারদে ক্যাম্প থাকাতে ওরা ধ্বংস করে গেছে এবং নয় মাস বন্ধ থাকার কারণে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। এ-রকম একটি স্কুলের বেহাল দশায় হাল ধরার জন্য তাহেরকে ঢাকায় বসে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জজ সাহেব নিয়োগ দিয়ে তাকে পাঠান। স্কুলটির চারজন শিক্ষককে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা করাতে শিক্ষকতা স্বল্পতাসহ প্রশাসনিক দ্বান্দ্বিক কারণেও নাজুক ছিল। তাহেরে এসে দেখে স্কুলকে ঘিরে নানা রকম রাজনীতি রয়েছে। মূলত জলেশ্বরীতে ক্ষমতার বলয়ে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব চলছে। একদিকে মহকুমা প্রশাসক হাকিম, দ্বিতীয় অলিখিত প্রশাসন চালায় ক্যাপ্টেন মজহার, তৃতীয় শক্তি স্থানীয় এমপি হাফেজ মোক্তার। কেউ কারো চেয়ে কম নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মজহার সরকারি চাকরি ছেড়ে এসে জলেশ^রীতে গেরিলাবাহিনী গঠন করে নিজেই ক্যাপ্টেন সাজে, যুদ্ধের পর সে অস্ত্র জমা না দিয়ে নিজের হাতে রেখে দিয়েছে নানা রকম অস্ত্র। হাফেজ মোক্তার সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে তার প্রভাব-প্রতিপত্তিও অনেক বেশি। কোনো সময় জলেশ্বরী মহকুমার হাকিম সাহেব কলের পুতুলও হয়ে যান, এমন পরিস্থিতিরই সৃষ্টি হয়েছিল। নড়বড়ে প্রশাসনের দায়িত্বে থেকে হাকিম সাহেব হিমশিম খেতে থাকেন আর আত্মদহনে দগ্ধ হতে থাকেন।

একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে অনুধাবন করা যায় যে তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা ও নৈরাজ্য কেমন ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অরাজকতার একটি নজির হলো পরীক্ষায় অবাধে ও ব্যাপকহারে নকল করা। জলেশ্বরী স্কুলে ছাত্ররা দাবি তুলল নকল করার সুযোগ দিতে কিন্তু তাহেরের পূর্বের হেড মাস্টার নকল করতে না দেওয়ার জন্যে নীতিতে অটল। স্থানীয় এমপি হাফেজ মোক্তার ছাত্রদের পক্ষ নিয়ে হেড মাস্টারকে প্রথমে সুযোগ দেওয়ার জন্য বললে হেড মাস্টার অবিচল, নীতিতে অটল। তারপর হাফেজ মোক্তার তাকে শাসানোতে হেড মাস্টার নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে বাধ্য হয়ে সব শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে ইস্তফা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় রেলস্টেশনে ছাত্ররা তাকে অপমান করার জন্য তৈরি হয়। শিক্ষককে সহযোগিতা করছে হাকিম সাহেব, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এই গ-গোলের চূড়ান্ত পর্যায়ে হাফেজ মোক্তারের ইঙ্গিতে হেড মাস্টারের গলায় জুতোর মালা পরিয়ে বিদায় করার সময় ক্যাপ্টেন গুলি করে চারজন ছাত্রকে আহত করে এবং নিজে গিয়ে তাকে কাউনিয়া রেলস্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসে।

ক্যাপ্টেন মূলত ভালো কাজ করার জন্যই নিজেকে নিয়োজিত করেছিল। কিন্তু দেশের প্রচলিত আইনকে অমান্য করে নিজেই যখন আইন বলবৎ করতে শুরু করে তখনই ব্যাপক নৈরাজ্য শুরু হয়।

ক্যাপ্টেন দু-একটি ভালো কাজ করলেও তার রাজত্ব ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। প্রতি রাতেই গোলাগুলির আওয়াজে এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি হতো। কিন্তু মানুষ ছিল অসহায়। অন্য দিকে দ্রব্যমূলের উর্ধ্বগতিও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ক্যাপ্টেন বিশ্বাস করে যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। যুদ্ধের এখনও অনেক বাকি। তাই তাকে অস্ত্র হাতে নিতে হয়েছে। তাহেরকে সে শোনায় তাত্ত্বিক কথা যে কথার অর্থ শত্রুদের শেষ করতে হলে অস্ত্র ছাড়া উপায় নেই। দীর্ঘ কথনে উঠে আসে :

সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি, দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই দেশ থেকে এক লহমায় অশুভ শক্তিসমূহ অন্তর্হিত হয়নি; এখনো অস্ত্র ধারণ ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সম্ভবত আগের চেয়ে, মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ের চেয়ে, এখনই প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে রয়েছে। পৃষ্ঠা ৮৫।

গভীর রাতের স্তব্ধতার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে আসে তাহেরেরও নিঃসঙ্গতার স্তব্ধতা। কখনও সে হাহাকারে ডুবে যায়। যে স্বপ্ন নিয়ে স্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করতে এখানে এসেছে সেই স্বপ্ন যেন ভেঙে যায় বারবার।

উপন্যাসের শেষের দিকে ক্যাপ্টেনের স্ত্রী হাসনা আসে জলেশ^রীতে। কাকতালীয়ভাবে মিলে যায় তাহেরের স্ত্রীর নামও ছিল হাসনা। তখন তার স্ত্রীর স্মৃতিগুলো যেন আরও ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। হাসনা যেদিন আসে সেদিন থাকার মতো কোনো সুবিধাজনক স্থান না পাওয়াতে স্কুলের একটি রুমে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। নির্জন নিস্তব্ধ রাতে দুজন স্কুলের বাসিন্দা। এক সময় তাহেরের অবচেতন মনেই কামনা-বাসনা উসকে ওঠে এবং তখন নিজেকে সংবরণ করার জন্য বারান্দায় বসে রাত কাটায়।

ক্যাপ্টেনের পক্ষে সাধারণ মানুষ ছিল। তখনকার নৈরাজ্য ঠেকাতে ক্যাপ্টেনকে জলেশ^রীর মানুষ পছন্দ করত। চোরাচালানি, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, ঘুষ ইত্যাদির প্রতিরোধের জন্য তাহেরই তাদের কাছে ছিল প্রকৃত দেশপ্রেমিক। সেই সময় সর্বহারা পার্টি, জাসদের গণবাহিনী, আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা আরও কিছু বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই অলিখিত বিচারের দায়িত্ব নিয়ে নিত। এই বিচারকে ন্যায়সংগত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিত। অপরাধীদের বিভিন্ন প্রকার শাস্তি দেওয়া হতো। আলোচ্য উপন্যাসে আজমি-পিপাসুকে যেভাবে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছিল তার বর্ণনা রয়েছে উপন্যাসে। এ-ধরনের মৃত্যুদ- বা বিচারের শাস্তি হতো জলেশ্বরীর শহিদ মিনার চত্বরে রাতের অন্ধকারে। সাধারণ মানুষ চাইত যাতে দেশের নৈরাজ্য কমে। দপ্তরি পরাণের বক্তব্যে তারই প্রমাণ পাওয় যায় :

চোরাচালানকারীদের বহুবার হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়, কিন্তু তারা শোনে নাই, আর শুনবেই বা কে?-বহু বহু বড় বড় লোকই দেশের এই শত্রুতাসাধনের সঙ্গে জড়িত। পরাণ বলে, ক্যাপ্টেন ছিল বলেই জলেশ্বরীতে এখনো যা কিছু সুবিচার আছে, লোকের মনে বল আছে যে অন্যায় একেবারে প্রতিকারহীনভাবে পার হতে পারবে না। পরাণ তার সুচিন্তিত মত প্রকাশ করে যে, আজ রাতে ক্যাপ্টেন বোধ হয় সেই প্রতিকার করতেই নেমেছে। পৃষ্ঠা ১০৯

হ্যাঁ, ওই রাতেই প্রতিকারে নামে কিন্তু ক্যাপ্টেন আর ফিরে আসে না। পরাণ জানিয়েছে যে, হাফেজ মোক্তারের দলের লোকেরা ক্যাপ্টেনকে হত্যা করেছে। এই মৃত্যুর সংবাদ হাসনাকে দিলে সে নির্বিকার এবং তার মুখে স্মিত হাসি। তার স্মিত মুখ দেখে তাহের ক্রোধ প্রকাশ করলে হাসনাও ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, ‘বাহ্, এই তবে স্বাধীনতা? এরই জন্যে স্বাধীনতা?’

উপন্যাসের শেষ পাতায় আরও বিস্ময়কর দুটি বিষয় বিধৃত হয়। একটি হলো স্কুলে বোমা ফাটানো হয় যার মাধ্যমে তাহের অনুমান করে স্কুল বানচাল করার গভীর ষড়যন্ত্র। বোমা ফাটানোর ফলে স্কুল আঙিনা ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। বোমা ফাটানো ও ধোঁয়ার আচ্ছন্নতা দিয়ে লেখক কী বোঝাতে চেয়েছেন? লেখক বোঝাতে চেয়েছেন যে, স্কুল আদর্শের প্রতীক। আলোর প্রতীক! এই স্কুল ভবিষ্যতের স্বপ্নের প্রতীক। এই আদর্শ, স্বপ্ন ও আলোর প্রতীককে ধ্বংস করতে চাচ্ছে অশুভ শক্তি। লেখক হয়তো তাই প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তারপর দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো স্টেশনে ট্রেন হুইসেল দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই হাসনার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। একজন শিক্ষিতা নারী মফস্বলের স্কুলে রাতের নির্জতায় আরেকজন পুরুষের সঙ্গে থাকা মোটেও সমীচীন নয় ভেবে তাহের হাত ধরে টান দিয়ে বলল যে চলুন। কিন্তু হাসনা হাত ছাড়িয়ে আবার পরক্ষণেই তাহেরের হাত ধরে বলল, ‘না।’

হাত ছাড়িয়ে পড়ে আবার হাত ধরার মধ্যে লেখক কী ইঙ্গিত করেছেন? হাসনা কি তাহেরের সঙ্গে সহযোদ্ধার ইঙ্গিত দেননি। উপন্যাসের শেষ বাক্যে লেখক এই ইঙ্গিতকে আরও পরিষ্কার করেন, “অচির কালের মধ্যে পায়ের তলায় মাটি কাঁপিয়ে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটে।” উপন্যাসের শেষ বাক্যটি ছোট কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাপক যা থেকে পাঠক অনুধাবন করতে পারে যে, হাসনা আর ফিরে যাবে না, সেও হবে তাহেরের সঙ্গে যোদ্ধা, প্রেমিকা। দুজনে মিলে আলোর ঘর, আদর্শের প্রতীক, প্রগতির সড়ক নির্মাণ করবে।

পূর্বেই বলা হয়েছে এই উপন্যাসে প্রত্যক্ষ উক্তিতে তেমন সংলাপ নেই, নেই কোনো আ লিক শব্দের ব্যবহার। তবে পরোক্ষ উক্তির ক্ষেত্রে হয়তো অসতর্কতার কারণে বেশ কিছু জায়গায় নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *