নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের ট্রিলজি : সমাজবাস্তবতার এক অনন্য দলিল
মোজাম্মেল হক নিয়োগী
ঔপ্যানিসক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের ‘বিলডাকিনি’, ‘দায়ভার’ ও ‘আদম সুরত’—এই ট্রিলজি বিলডাকিনি ও ভবানিপুরের গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে রচিত। ট্রিলজির বৈশিষ্ট্যানুযায়ী এগুলো প্রতিটি স্বতন্ত্র উপন্যাস আবার আখ্যানের যোগসূত্রতার কারণে ‘ত্রিলেখ’ বা ‘ত্রয়ী উপন্যাস’ বা ট্রিলজি’র মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। এই ‘ত্রিলেখ’ ক্যানভাসে ধূর্ত ক্ষমতাবানদের দাপট ও দৌরাত্ম্য, সম্পদ ও নারী–লিপ্সা, নির্যাতন, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, মৌলবাদের দুর্দণ্ড প্রতাপ, প্রতিবাদী নারীর জাগরণ, গ্রামীণ রাজনীতির বিষবাষ্প, সর্বহারা পার্টির আবছা উপস্থিতি এবং সর্বোপরি মানবিকার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত। এই আলেখ্যে অসংখ্য জট–জটলা, কূটচাল, দ্বন্দ্ব–সংঘাত এবং সফল দ্বন্দ্ব নিরসন ট্রিলজিতে উপস্থিত। ক্যানভাসের পটভ‚মিতে বিমূর্ত আভা ছড়িয়েছে দ্বা›িদ্বক বস্তুবাদ, অস্থিত্ববাদ ও ভাববাদ দর্শন। তিনটি খণ্ডেই লেখক যেমন সংকটের জটিল জালের বিস্তার ঘটিয়েছেন ঠিক তেমনই সংকট কাটিয়ে সরল পথে আখ্যানের পূর্ণতাও দান করেছেন। উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট হানুফা ও তার অবৈধ গর্ভজাত সন্তান আদম সুরতকে কেন্দ্র করে তিন খÐ উপন্যাসই নির্মিত হয়েছে। বিলডাকিনি ও ভবানিপুর এবং সময়ের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা কিংবা কোনো মাইলস্টোনের মাধ্যমে উল্লেখ না থাকলেও তৃতীয় খণ্ডে ভারতের এনআরসি, করোনাকাল ও মোবাইল ফোনের আবির্ভাবের মাধ্যমে কাল নির্ধারণের মানদণ্ড স্পষ্ট হয় যখন আদম সুরত ভ্রƒণ থেকে পূর্ণ যুবক ও বিসিএস ক্যাডার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। এই হিসেবে সময়ের ব্যাপ্তি এই ত্রয়ী পঁচিশ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও ফ্ল্যাশব্যাকে সাতচল্লিশের দেশ ভাগের মর্মন্তুদ ঘটনার বিষাদের স্রোতে প্রবাহমান।
বাংলাসাহিত্যে অবৈধ সন্তানকে নিয়ে সংগ্রাম করে নিয়ে গ্রামীণ জনপদে মায়ের জয়ী হওয়ার কোনো উপন্যাস লেখা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। বিলডাকিনি গ্রামের জুতদার, ক্ষমতা লিপ্সু ও দখলবাজ বাচ্চু মোল্লার প্রতিবেশী হতদরিদ্র বোকাসোকা আকবর যে অচন্দ্রচেতন, যৌন–নিস্পৃহ ও সন্তানদানে অক্ষম হিসেবে তার স্ত্রী হানুফা জানে। পাড়াপ্রতিবেশী হিসেবে বাচ্চু মোল্লার সম্পর্কে ভাতিজা আকবর। আকবরের স্ত্রী হানুফাকে ভোগ করার জন্য বাচ্চু মোল্লা সর্বহারা পার্টির সদস্য বলে মিথ্যে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে হানুফাকে বলপূর্বক ঠান্ডা মাথায় রাতের পর রাত ধর্ষণ করে এবং এক সময় হানুফা গর্ভবতী হলে তার গর্ভপাত করার জন্য চাপ দিয়ে লোক মারফর সদরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে বাচ্চু মোল্লা। মানুষ যা ভাবে, বিধি তা ভাবে না। বিধির হিসাব–নিকাশ ভিন্নখাতায় হয়। আধুনিকমনস্ক লেখক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর মানবভ্রƒণকে বাঁচিয়ে মধ্য দিয়ে উপন্যাসের ক্যানভাসে অস্থিত্ববাদের বীজ বপন করলেন, অস্তিত্ববাদকে ধারণ করলেন এবং যে লোকের মাধ্যমে তাকে শহরে পাঠানো হয়েছিল সে লোকের কারসাজিতে হানুফা আকবরের সঙ্গে জেলখানায় সাক্ষাতের পর সে জানতে পারে যে, বাচ্চু মোল্লার ষড়যন্ত্রে আকবর জেলে। এবং একই দিনে ওই লোক অর্থাৎ যার পরিচয় পাওয়া যায় দ্বিতীয় খণ্ডে, সর্বহারা পার্টির হিরণ, বাচ্চু মোল্লাকে খুন করে বিলডাকিনিতে ফেলে দেয়। উপন্যাসের নৃশংসতা ও যৌনতার এক অবর্ণনীয় রূপ বিলডাকিনি বিলে নৌকার মধ্যে ওই রাতে শিহরন জাগানোর মতো ঘটনা। খুনি হিরণ গর্ভবতী হানুফার পেটের বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য পরামর্শ ও চাল দিলেও দুই লাখ টাকার জন্য বাচ্চু মোল্লাকে খুন করার পর সেই হানুফাকে সেও ধর্ষণ করে যার মাধ্যমে ফ্রয়েডের অবদমিত ও চেতন–অবচেতন প্রবৃত্তির যৌন তাড়নার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ উৎকীর্ণ হয়েছে উপন্যাসে। যৌনপ্রবৃত্তি মানুষকে কতটা নিকৃষ্ট স্তরে নিতে পারে তার একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ এই উপন্যাসে সৃষ্টি হয়েছে।
লেখক সুকৌশলী। তিনি গল্পটিকে সরলসোজা পথে নিয়ে যাননি। পথে পথে বাঁক ঘুরিয়েছেন, পাঠককে বিভ্রমে ফেলেছেন এবং বাঁকের পরে হারিয়ে যাওয়া গল্পকে আবার টেনে নিয়ে এসেছেন পাঠকের সামনে। যেমন– বিলডাকিনি খণ্ডে বাচ্চু মোল্লা খুন হওয়ার পর তার মামলা ও আসামির বিচার দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে বিস্তৃতি লাভ করে। প্রথম খণ্ড হানুফার গর্ভে অবৈধ সন্তান জানাজানি হলে তাকে বাচ্চু মোল্লার মেয়ের জামাই এডভোকেট ইব্রাহিম যে কি না বাচ্চু মোল্লার সম্পদ ও ক্ষমতার উত্তরসূরি, গ্রামের রাজনীতিতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উঠে পড়ে লাগে, সে মসজিদের ইমামকে নিয়ে সম্পত্তি ও বাড়ি দখল করার লোভে তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়র গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। চাপাচাপি করা হয় গর্ভের সন্তানের বাবার নাম জানার জন্য। কিন্তু হানুফা সন্তানের বাবার নাম প্রকাশ করেনি। হানুফাকে রক্ষা করার জন্য বাচ্চু মোল্লার দ্বিতীয় মেয়ে কলেজ পড়–য়া বিউটি ভবানিপুরের বারীণ মাস্টারকে নিয়ে গ্রামের সালিসে ইব্রাহিমের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানবতার প্রতীক নিঃসঙ্গ বারীণ মাস্টার যার বংশের সবাই সাত চল্লিশের দেশভাগের সময় কলকাতায় চলে যায় আর বারীণ মাস্টার মাতৃভ‚মির টানে এলাকায় আলো ছড়ানোর জন্য থেকে যান, তাকে নিয়েই বিউটি প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয় এবং শেষ পর্যন্ত হানুফাকে বারীণ মাস্টার নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। সালিসের এ–রকম মীমাংসার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় প্রথম উপন্যাস বা খÐ।
‘দায়ভার’ দ্বিতীয় উপন্যাস বা দ্বিতীয় খÐের গল্পের নাটকীয়তার দ্যোতনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিক ও শিক্ষা ব্যবস্থার নাজুক পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক। চরিত্র চিত্রণের মাঝেই সমাজের চিত্রও ফুটে উঠেছে। গ্রামীণ সমাজের সংস্কার–কুসংস্কার, কৃষ্টি–সংস্কৃতি ও রীতিনীতি, ধর্মীয় বিশ^াসের বিষয়গুলো ধীরে ধীরে বিকশিত হয় উপন্যাসে। হানুফাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বারীণ মাস্টারের প্রতি সমাজের মানুষের কানাঘুষা শুরু হয়। তবে শত ষড়যন্ত্রের জালের বিস্তার থাকলেও বারীণ মাস্টারকে আদর্শের স্থান থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। হানুফাকে নিজ কন্যার মর্যাদা দিয়ে তার গর্ভের সন্তানকে নিরাপদে পৃথিবীতে আসার যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি করেন। এই চরিত্রের মাধ্যমে লেখক অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক অনন্য মজবুত পিলার স্থাপন করলেন। তাঁকে সহযোগিতা করে আর এক আদর্শ ও মানবতার প্রতীক হিসেবে দাঁড়ায় গ্রাম্য ডাক্তার সোরহাব। পিতৃ–পরিচয়ের সংকটে আদম সুরতের জন্মসনদের জটিল জটলা পাকায়। হানুফার সন্তান আদম সুরতের জন্মসনদ ও স্কুলে ভর্তির সময় সমাজের মানুষের নিগৃহীত আচরণও বারীণ মাস্টার মোকাবিলা করেন ইউএন–র মাধ্যমে। আদম সুরতকে তিনি নিজ দায়িত্বে বাড়িতে রেখে লেখাপড়া করান এবং একদিন আরেকটা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে আদম সুরত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিভাবান ছাত্রত্বের মর্যাদা পায়।
এই খণ্ডে তদন্তের মাধ্যমে জানাজানি হয় যে, হানুফার গর্ভের সন্তান বাচ্চু মোল্লারই অবৈধ সন্তান। বিউটি এডভোকেট হয় এবং সেও জানে হানুফার সন্তান তারই পিতার ঔরসজাত। মনস্তাত্তি¡ক গভীর সংকটের আরও একটি জাল বিস্তার লাভ করে। প্রগতিশীলতার প্রতীক বিউটি হানুফার মর্যাদার ক্ষুন্ন করেনি। পিতার পাপের ভার নিজের কাঁধে ধারণ করে হানুফাকে নারীত্বের ও মাতৃত্বের মর্যাদায় ঋজু থাকার পথ তৈরি করে দেয় বিউটি। বিউটি হয়ে ওঠে এক অনন্য মহিয়সী নারী চরিত্র। বিউটির চরিত্রের অন্তর্দহন যদিও পরিস্ফুটিত হয়নি, তথাপি পাঠক তার অন্তর্দহনের বেদনা অনুভব করতে পারে।
আদম সুরতের জন্মসংক্রান্ত সংকট ও জটলার গ্রন্থিমুক্ত হয়ে দ্বিতীয় খণ্ডে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি লাভ করে। তৃতীয় খণ্ডে আদম সুরতের শৈশব থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, বিসিএস ক্যাডারের চাকরি পাওয়া এবং নিকিতার প্রেমের শেষ পরিণতিতে শেষ হয়। আবার সংকটের মুখোমুখি পুলিশের ভ্যারিফিকেশনের সময়। তার বাড়িঘর কিছুই নেই। নেই পিতৃ–পরিচয়। তবে সরলীকরণের ঘটনা ঘটে যায় উদার ওসির বদান্যতার কারণে। সংকটের নিরসন হয়। এত সহজ ও সরলভাবে এই সংকটের নিরসন না হলে, আরও জটলা পাকালে হয়তো উপন্যাসের আকর্ষণ আরও বাড়ত। এখানে মনে হয়েছে লেখকের কিছুটা তাড়াহুড়ো কিংবা নিজের সরল ও উদার মনের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
এদেশের রক্ষণশীল সমাজে পিতৃ–পরিচয়হীন কোনো মানুষের বাধাবিপত্তির কোনো শেষ নেই। আদম সুরতের প্রেমিকা নিকিতার সঙ্গে বিয়ের সময় নতুন করে আবার সৃষ্টি হয় মনস্তাত্তি¡ক সংকট। প্রতিপত্তিশালী সরকারি আমলার সুশিক্ষিত মেধাবী সুন্দরী মেয়ে নিকিতাকে কী করে পিতৃ–পরিচয়হীন কোনো সন্তানের সঙ্গে বিয়ে দেয়? বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি অসম্ভব ঘটনা। বুদ্ধিমতী নিকিতা প্রেমকেও অস্বীকার করতে পারে না, হার মানতেও রাজি নয়। নৃ–বিজ্ঞানের ছাত্রী নিকিতা আদম সুরতের পরিচয় জানতে বেরিয়ে পড়ে অনুসন্ধানের নিমিত্তে। এখানেও সংকটের সরল সমাধান দেখা যায়। কৌশলী লেখক কাহিনির বিশ^স্ততা ও যৌক্তিকতার জন্য পূর্ব থেকেই একটি যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছেন। নির্মাণের কৌশলের কারণে আরোপিত ঘটনার কোনো সন্দেহ পাঠকের মনে দানা বাঁধার সুযোগ পাবে না। সেই জেলার ডিসি সাহেব তৈরিই থাকেন নিকিতার বাবাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এবং আদম সুরতের পরিচয় উদ্ঘাটন করতে সহযোগিতা করেন। একটি যোগসূত্র তো আছেই। এখানেই নিকিতার বাবা এক সময় ইউএনও–র চাকরি করে গেছেন। তারই সূত্র ধরে সহজ বিন্যাস।
বিউটি তখন জেলা জজ। নিকিতা হানুফাকে খুঁজতে গিয়ে বিউটির বাসায় হাজির। মেয়েকে খুব পছন্দ হানুফার। নাটুকে পরিসমাপ্তি হলেও অসংগতি মনে হয়নি। আদম সুরত এসে হাজির। উপন্যাসের সিনেমাটিক পরিণতি হলেও নিকিতার সঙ্গে আদম সুরতের বিয়ের ঘটনায় নিকিতাকেও প্রগতিশীল মননে সৃষ্টি করা হয়েছে যদিও শেষ পর্যন্ত নিকিতা বা আদম সুরত জানতে পারে না আদম সুরতের জন্মরহস্য।
গল্প–উপন্যাসে চরিত্র সৃষ্টি করা আর সৃষ্ট চরিত্রে রক্তমাংস দেওয়া দুটি দুই জিনিস। যেমন– বায়োফিকশন বা বাস্তব ঘটনায় চরিত্রের সৃষ্টি হয়ে থাকে, লেখকের কাজ হলো চরিত্রের কঙ্কালে রক্তমাংস দিয়ে চরিত্রকে প্রাণ দেওয়া ও কাহিনিকে নির্মাণ করা। এ কারণে চরিত্র সৃষ্টি করার মধ্যে দিয়ে লেখকের শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। মহৎ ও বিখ্যাত লেখকরা চরিত্র সৃষ্টির মধ্যেও যেন আনন্দ খুঁজে পেতেন। চরিত্র সৃষ্টিতে ফরাসি লেখক বালজাকের ঔৎসুক্য আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। বালজাক তার হিউম্যান কমেডি উপন্যাসে পাঁচ হাজার চরিত্র সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেন, থেমে গেলেন আড়াই হাজার পর্যন্ত চরিত্র সৃষ্টি করে। কাফকার ম্যাটাফরসিস চরিত্রটি সাহিত্যের ইতিহাসে ধ্রুপদী চরিত্র হয়ে গেল। মিথ বললেও অসুবিধে নেই। চরিত্র সৃষ্টি ও চিত্রণ লেখকের শক্তিশালী গুণ ও ক্ষমতা। চরিত্র যখন পাঠকের করোটিতে বাসা বানায় তখনই সেই চরিত্র সফল, মহৎ এবং এই সাহিত্যকর্মটি স্থায়ীত্ব লাভ করতে সক্ষম হয়। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের ত্রয়ীতে চরিত্রচিত্রণে সৃজনশীল নিষ্ঠা ও দুর্দান্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন যার মাধ্যমে সমাজের অন্ত্যজ ও সম্পদ ও ক্ষমতালোভীদের নিকৃষ্ট ও নিষ্ঠুর আচরণের বাস্তব ছবি পাঠকের চোখে ধরা পড়ে। নারী চরিত্র নির্যাতিতা হার না মানা হানুফা, প্রগতিশীল ও মানবিকতার মননের অন্যন্যা বিউটি, মানবতার কাণ্ডারী শিক্ষার আলো ছড়ানোর প্রতীক বারীণ মাস্টার ও সোরহাব প্রভৃতি চরিত্রগুলো পাঠকের মনে স্থায়ীভাবে দাগ কাটে এবং নারী চরিত্রগুলো বাংলা উপন্যাসে হুরমতি, জয়গুন, রাবেয়া, সারেং বৌ প্রভৃতি চরিত্রের মতো পাঠকের মনে স্থায়ীভাবে দাগ কাটতে সক্ষম হয়। আকবরের চরিত্রটি আউটসাইডার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে কিন্তু তার অনুপস্থিতির বেদনার রস কি পাঠকের মনে সিঞ্চিত হয় না? একটি নিরপরাধ সহজ–সরল মানুষ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে প্রথমে জেল খাটে এবং মুক্তি পেয়ে স্ত্রীর ঘটনা জেনে একদিন আদম সুরতকে আড়ালে থেকে সে সমাজ থেকে চিরদিনের জন্য অন্তর্হিত হয়ে যাওয়ার ছায়া কি পাঠকের মনে থাকে না? নিশ্চয়ই থাকে। কাকতালীয়ভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনা : বারীণ মাস্টারের ছায়া যেন বর্তমান লেখকের তৃতীয় অধ্যায় উপন্যাসে অধ্যাপক প্রীতিশ কুমার মÐলের মধ্যে লক্ষ করা যায়। তবে প্রীতিশ কুমার মÐল কোনো সামাজিক আন্দোলন ও শিক্ষা বিস্তারে জড়িত নয় যেমনটি বারীণ মাস্টারের চরিত্রের দেখা যায়। এই হিসেবে বারীণ মাস্টারের চরিত্র উজ্জ্বলতর।
লেখক কেবল একটি জেলার নাম উল্লেখ করেছেন সেটি হলো কুষ্টিয়া যেখান থেকে সর্বহারা পার্টির মিহির এসেছিল। আর কোনো স্থানের উল্লেখ না থাকলেও পাঠকের মনে হতে পারে এটি পদ্মার পশ্চিম পারের কোনো অঞ্চলকে কল্পনা করে লেখক সৃষ্টি করেছেন এই ত্রয়ী। উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রকৃতি, পেক্ষাপট, পরিবেশ, চরিত্রের অবস্থা ও অবস্থান, তাদের সংস্কৃতি–চর্চা, জীবনধারণের উপায় ও উপাদান ইত্যাদির যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে একটি উপন্যাস সার্থক হয়ে ওঠে।
উপন্যাস ত্রয়ীতে লেখক চরিত্রচিত্রণ ও পরিবেশকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে শরৎচন্দ্রের চরিত্র নির্মাণের সঙ্গে নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের চরিত্র নির্মাণের বৈপরীত্য লক্ষ্যণীয়। শরৎ–সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলো বিদ্রোহিনী হয়ে ওঠেনি কিন্তু এই ত্রয়ীতে বাচ্চু মোল্লার কনিষ্ঠ কন্যা বিউটি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং হানুফাকে সে ভগ্নি¯স্নেহে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় দিয়ে যায়। এই সম্পর্ক এক জটিল জাল বিস্তার করেছে যা টাইপড চরিত্র নয়। আশাপূর্ণ দেবীর ট্রিলজির সত্যবতী ও বকুলের মতো বিউটিও বিদ্রোহী সোচ্চার নারীকণ্ঠ। সমরেশ মজুমদারের ট্রিলজির দ্বিতীয় খণ্ডের ‘কালবেলা’র মাধবীলতাও এক বিদ্রোহী নারী চরিত্র হিসেবে পাঠককে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। এই উপন্যাসে মনস্তাত্তি¡ক সংকট এতটা গভীর যে পাঠক বিমূঢ় হতে বাধ্য। কেননা, বিউটি জানে তাঁরই পিতার পাপাচারে হানুফার গর্ভে আদম সুরতের জন্ম, সেই বিউটিই হানুফাকে নিজের বাসায় থাকতে দিয়েছে এবং আদম সুরত যখন তাকে বিউটি খালা ডাকে তখন তার হেঁচকি ওঠে—বাংলা সাহিত্যে এমন বিস্ময়কর মনোজাগতিক সংকটময় চরিত্র কোনো গল্পে উপন্যাসে সৃষ্টি হয়েছে কি না জানা নেই। এই প্রসঙ্গে যতীন সরকারের কথাগুলো প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “অথচ উন্নতমানের শিল্পসাহিত্য কখনো বাস্তবের আকাড়া প্রতিফলন ঘটনায় না। আপাত প্রতীয়মানতার বাইরে বাস্তবের যেসব মাত্রা সাধারণের কাছে সংগুপ্ত থাকে, প্রতিভাবান শিল্পী সাহিত্যিকদের চৈতন্য সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটে এবং সেই প্রতিফলনেরই তিনি শিল্পিত রূপ দান করেন।” (প্রতীচ্য সাহিত্য ও সমালোচনা তত্ত্ব, সম্পা : বেগম আকতার কামাল, পৃষ্ঠা ১০০) শরৎসাহিত্যে যদিও নারীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেনি তা কালের বিচারে, কিন্তু দেড়শ’ বছর আগের বাস্তবতা আর আজকের বাস্তবতা এক নয়। এখন নির্যাতিত নারীরা বিদ্রোহ করবে এটাই বাস্তবতা, সময়ের দাবি, পরিবর্তনের সূচক, নারী জাগরণের ও জীবন জয়ের জন্য তারা হবে অদম্য ও জয়িতা। বিউটির চরিত্রটি অন্যভাবেও পাঠককে ভাবিয়ে তোলে। সে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, প্রথমে এডভোকেট এবং পরে বিচারক হন কিন্তু তিনি থেকে যান চিরকুমারী। প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক যে, কেন তিনি চিরকুমারী থেকে গেলেন। তিনি কেন কোনো প্রেমে বা বিবাহ বন্ধনে জড়াননি। এই প্রশ্ন পাঠকের মনে দেখা দিলেও লেখক বিউটির প্রেম–বিবাহের ব্যাপারে নিস্পৃহ থেকেছেন। পাঠককে ভাবনার বৃত্তে আবর্তিত হওয়ার কৌশলই হয়তো বেছে নিয়েছেন। উপন্যাসে সব প্রশ্নের সমাধান থাকবে এমন কোনো কথা নেই। আধুনিক উপন্যাস এই দাবি মিটাবে কেন?