পাঠের অনুভূতি
‘বসন্ত ছোঁয়নি মন’ : একটি পরাবাস্তব গল্প
তারিকুল আমিন
(প্রাবন্ধিক, গল্পকার, আবৃত্তিকার ও অভিনয় শিল্পী)
‘বসন্ত ছোঁয়নি মন’
আশরাফ আলী চারু
ধরন : উপন্যাস।
প্রচ্ছদ : কামরুল আলম।
প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২২
প্রকাশক : মাহির প্রকাশন।
মূল্য: ২০০ টাকা
‘বসন্ত ছোঁয়নি মন’ কী অদ্ভুত কথা! বসন্তের দিন কেন বসন্ত ছোঁয়নি? এক বসন্ত যায়, আরেক বসন্ত আসে। স্বপ্ন চলে যায়, আবারো ফিরে আসে এ ধরায়। বাসন্তী রঙের ঢেউয়ে দুলে উঠবে, ফুলে উঠবে আর কে না জানে। খোঁপার মতন নেই কোন আর ফুলদানি। ফুল ফুটবে নারীর খোঁপায় খোঁপায়। ফুলের বাহারি রঙে সাজবে শাড়ির আঁচল। ‘বসন্ত ছোঁয়নি মন’ বইটির প্রথম দর্শনে যে তিনটি শব্দ পড়লে কেমন জানি একটা রহস্যঘেরা প্রতিচ্ছবি চোখের মধ্যে ভেসে আসে। মনের অজান্তেই প্রশ্নগুলো ছুটে বেড়ায়। বসন্ত কেন ছোঁয়নি! কাকে স্পর্শ করেনি! আর ছোঁয়নি বলে কি এমন হয়েছে? এই ধরণের অদ্ভুত অদ্ভুত রহস্য মাথায় ঘুরপাক খাবে পাঠকের মনে। যেমনটি আমার হয়েছে। “পুষ্প ছিল বৃক্ষশাখে, হে নারী, তোমার অপেক্ষায়”-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
হয়তো আমি অতটা বসন্তপ্রেমী নই। হয়তবা প্রেমিকপুরুষ নই। বইটির সাথে প্রথম দর্শন হয় বইমেলায়। নব ভাবনার স্টলে। কবি আমাকে তার উপন্যাসটি হাতে দেন। বইটি বিক্রি করার জন্য। বইটির নামটা কেমন অদ্ভুত লেগেছে। মনে মনে যেমন রহস্য সৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিকে আবার উঁকি দিচ্ছে এমন সহজ নাম হয় উপন্যাসের। শেষের কবিতা, চোখের বালি, মা, গোরা, পথের পাঁচালী, বসন্ত বিলাপ প্রভৃতি এই নামগুলো কত সুন্দর। নামটি পড়ার পর মনে হচ্ছে খুব সহজ হয়ে গেছে। আবার অন্যদিকে আরেকটি প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে মনের মাঝে তা হচ্ছে নামটি সহজ বটে তবে কেমন জানি রহস্য রহস্য গন্ধ পাওয়া যায়। ‘বসন্ত ছোঁয়নি মন’ কাকে ছোঁয়নি? ছেলে নাকি মেয়ে? নাকি দুজনের একজনকেও না।
বইটির প্রথম দুই অংশ বইমেলায় পড়েছি। প্রথম অংশটি পড়তে গিয়ে একটু বিরক্ত লেগেছে। স্কুল কলেজের কথা মনে পড়ে যায়। পড়তে গিয়ে লেখকের উপর খুব ক্ষুদ্ধ হয়। সেই সাল আর সাল। এই সাল জিনিসটা খুব ব্যথা দেয় মনে। অবশ্য আমাকে একা নয়। ছাত্র জীবনে এই সাল জিনিসটা মুখস্থ করা খুব কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। কবিদের জন্ম ও মৃত্যুর সাল। রাজাদের আমলের সাল। তাদের যুদ্ধের সাল। প্রতিটা ছাত্র–ছাত্রী সাল মুখস্ত করতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে বলে, কেন যে পড়াশোনা করতে হয়। কে যে লেখাপড়া বের করেছে। ঐ ভদ্রলোকে হাতের কাছে পেলে…ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এখন আর অতটা বিরক্তবোধ করি না। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
বইটি আমার কেনা হয়ে ওঠেনি। কারণ ২০২১ সালের বইমেলায় আমি প্রায় পনেরো হাজার টাকার বই কিনেছি। তার মধ্যে সময় টেলিভিশনের পক্ষ থেকে কুইজ খেলে প্রায় সাত হাজার টাকার বই পাই। এরপর বইমেলা শেষে নব ভাবনার লাইব্রেরি থেকে বইটি সংগ্রহ করি। বইটি আমার দোকানে রাখি। ঠিক তার দুদিন পর দোকানে বসে সকাল সাতটায় বইটি পড়তে বসি। পড়তে পড়তে কিভাবে যে দশটা বেজে গেল টেরও পেলাম না। একদিকে দোকান সামলাচ্ছি অন্যদিকে বই পড়ছি। প্রায় সাড়ে দশটায় ঘড়ি দেখি। এতো দ্রæত পড়া শেষ। আমি নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি মনে করি কবির সার্থকতা এটাই। পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রথম এক বসায় উপন্যাস পড়েছি আমি। আমি এতটাই অলস যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। বই পড়ার আগে আমি কতবার যে পৃষ্ঠা গুণি হিসাব নেই। এক পৃষ্ঠা পড়লে তিনবার পৃষ্ঠা গুণি। পড়তে গিয়ে অনেক জায়গায় বিরক্ত লেগেছে। পরে ভাবলাম হয়তো মাঝে–মাঝে কাস্টমার সামলানোর জন্য হয়েছে বা শিশুদের চেঁচামেচিতে এমনটা হয়েছে। পরে বাসায় নিয়ে গেলাম বইটা।
এক নিঃশ্বাসে পড়ার মতো একটা বই। এক বসায় পড়তে পড়তে কখন যে সময় শেষ হয়ে গেল ঠাহর করতে পারিনি। যদিও মাঝখানেতে এসে একটু বিরক্ত হয়েছে এবং মাঝে মাঝে চমৎকার ভাবে অদ্ভুত মিরাক্কেল ঘটিয়েছেন। যা কখনো উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে আঁচ করতে পারেনি। পড়তে গিয়ে প্রথমে মনে করেছি যে, এখনকার লেখকরা তো সেই চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে লেখে। হয় নায়িকা বিষ খায় অথবা নায়ক ক্যান্সারে মারা যায় এমনটি হবে। কিন্তু না এমনটা হয়নি। প্রায় তিনটি স্থানে তিনটি মিরাক্কেল ঘটিয়েছে। আশরাফ আলী চারু তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন। গল্পটাও খুব সাবলীলভাবে এগিয়ে নিয়েছেন।
অ্যালান লাকেইন বলেন, How to get control of your time and your life. রিক্সার ড্রাইভার তাঁর করুণ পরিণতির কথা বলেছেন। তিনি সময়কে কতটা নষ্ট করেছেন। সময় নষ্ট করার কারণে আজ তাঁর সব হারিয়ে গেছে। রিক্সাচালক বলল, ‘সময়ের সঠিক মূল্যায়ন শিখতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে, স্যার!’ রিক্সাওয়ালার এই অভিজ্ঞতা আমাদের পাঠককে ভাবতে শেখাবে। সময়কে কাজে লাগাতে শেখাবে।
শিহাব, শাওন, বড় আপা, শাওনের মা, শামীমা পারভীন তনু এই পাঁচটি চরিত্র উপন্যাসে রয়েছে। তরু শব্দের অর্থ কোমল ও সুন্দর। পারভিন নামের অর্থ নীল সাদা তারকা। শামীমা নামের অর্থ সুগন্ধ। প্রথম দিকে যখন পাঠ করি তখন বুঝতে পারিনি যে তিনটি নামের সঠিক ও যথার্থ ব্যবহার করবেন। তিনটি নামের অর্থের সাথে তনু সত্যিই একজন কোমল মতি মেয়ে যে কিনা সুগন্ধি ছড়ায় নীল আকাশের বুকে তারা ভরা রাতের মত। শিহাব ও তনুর প্রেম কত ঝড় বয়ে বেরিয়েছে শুরুতে ভেবেছি উপন্যাসটির কাহিনী গড়াবে ‘দেবদাস’ উপন্যাসের মত। নিজের জীবন নষ্ট করবে তনু হারানের বেদনায়। কিন্তু তা উপন্যাসের নায়ক দেখি ভিন্ন। দুজনই বেশ বুদ্ধিমান ও বুদ্ধিমতি। তবে তনু সব সময় শিহাবের খোঁজ খবর রাখে তা বুঝতে পেরেছি। কারণ শিহাব ভেবেছে তনুর বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু তনু সেই সংসার করেনি তা জানতো না শিহাব। তাই নিজের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু শিহাব নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি এই বলে, তনু আমাকে প্রতারক ভেবেছে। এরকম মান অভিমান, রোমান্টিক ঘরানার কাহিনী সত্যিই অসাধারণ। শেষে তনু আর শিহাবের মিল সত্যিই আমার চিন্তা শক্তির বাহিরে ছিল। অসাধারণ ভঙ্গিতে লিখেছেন লেখক। পাঠক পড়লে বুঝতে পারবেন। কবি কতটা সহজ সরল ভাবে তার দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে এই ভালোবাসাটাকে রূপ দিতে।
উপন্যাসটিতে যেমন রয়েছে রোমান্টিকতার অনুভূতি। আরও রয়েছে কবির শেরপুরের অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য। আরো উঠে এসেছে এই উপন্যাসে একটি মেয়ের পারিবারিক ¯ স্নেহ–মমতা বঞ্চিত গল্প। একজন মেয়ের অসহায়ত্ব ও ভালোবাসাময় ভালোবাসার কথা। যা পাঠ করলে সকল পাঠকের অন্তরে গেঁথে যাবে বলে বিশ্বাস করি।
কথায় আছে– আগে দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী। একটা বইয়ের প্রচ্ছদ আমার মতো খুঁতখুদে মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ‘বসন্ত ছোঁয়নি মন’ বইয়ের প্রচ্ছদ এমন হওয়া উচিত ছিল যে একদম ছিমছাম, মার্জিত রংয়ের প্রচ্ছদই যেন পুরো উপন্যাসটা চোখে দেখায়। দৃশ্যমান হয়ে উঠে। তবে প্রচ্ছদ খুব একটা পছন্দ হল না। প্রচ্ছদটা আরো ভালো হওয়া উচিত ছিল। কারণ ভিতরে তাঁর লেখাটাতে অসাধারণ শব্দচয়ন, অতুলনীয় প্লট, সাবলীল বর্ণনা। এ ছাড়াও বোনাস হিসেবে ধাক্কায় ধাক্কায় বইয়ের নামের যথার্থতা। যদিও এটা তাঁর লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস। এত সুন্দর একটি উপন্যাসের প্রচ্ছদটা আরো উন্নত হওয়ার দরকার ছিল।
আশরাফ আলী চারুর “বসন্ত ছোঁয়নি মন” বইটি সকল পাঠকের কাছে অনন্য একটি উপন্যাস হয়ে উঠবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তাঁর অনন্য রসবোধ ও অনুপম রচনাশৈলী বইয়ের প্রতিটি রচনাকে পাঠকের কাছে আরও বেশি উপভোগ্য করে তুলবে।