ফেরারী সূর্য : রাবেয়া খাতুন

রাবেয়া খাতুন : ফেরারী সূর্য

 

রাবেয়া খাতুনের জীবনীকে পৃথকভাবে আলোচনার দাবি রাখে। কারণ, তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন বর্তমান সময়ের মতো মেয়েদের লেখাপড়া, বাড়ির বাইরে যাওয়া, লেখালেখি করা ইত্যাদি সহজ ছিল না। তখন সময়টা ছিল আরও বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন, যদিও এখনও অন্ধকার পুরোপুরি ঘোচেনি। তিনি কেমন পরিবেশে বড়ো হয়েছেন তার দুটি উদাহরণ হয়তো পাঠক চিন্তার রসদ পাবেন। রাবেয়া খাতুনের বড়ো এক দিন জানালেন যে, তার শ্বশুর বাড়ি থেকে আপত্তি জানিয়েছে তিনি যেন লেখালেখি না করেন। কারণ, রাবেয়া খাতুনের হাতের লেখা অন্য মানুষেরা দেখতে পায়। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো তাঁরা যখন পুরান ঢাকায় থাকতেন (তখন অবশ্যই ঢাকার প্রাণকেন্দ্র ওই এলাকাই ছিল) তখন গান করার জন্য মহল্লার মানুষ নিষেধ করত। তবে তিনি ফাঁকে ফাঁকে গান গাইতেন। এই দুটি ঘটনার মাধ্যমে সহজেই বোঝা যায় সেই সময়টা কেমন ছিল, কেমন ছিল মুসলমানদের মনমানসিকতা। তখন এদেশের মেয়েরা ছিল কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির নিরেট চার দেওয়ালে বন্দি। কেউ কেউ যদিও সে দেওয়াল ভেঙে বাইরে এসেছেন এবং তারাই মূলত এই দেশের নারী-সমাজের জন্য আলোক-বর্তিকা হয়ে পথ দেছিয়েছেন। এই দেশের নারী জাগরণের অগ্রপথিক, প্রথম বাতিঘর বেগম রোকেয়ার মৃত্যুর তিন বছর পরই রাবেয়া খাতুনের জন্ম। তাঁর সমসাময়িক বাংলাসাহিত্যের আরও দুজন যুগ স্রষ্টা  কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান ও সেলিনা হোসেন নিজ নিজ প্রতিভায় বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

রাবেয়া খাতুন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালের ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ। তাঁর প্রতিভার শিখা দীপ্তিমান ছিল সাহিত্যাঙ্গনে। না-হয় কিশোরী বয়সেই উপন্যাস লেখার মতো দুঃসাহসিক কাজটি করতে পারতেন না। মা চাইতেন না তিনি লেখালেখি করুন কিন্তু বাবার উৎসাহ ব্যতীত অনীহার কথার প্রমাণ মিলে না। কিশোরী বয়সেই ‘নিরাশ্রয়া’ উপন্যাস লিখেছেন বলে জানা যায় কিন্তু সেটি অপ্রকাশিত রয়েছে গেছে।

বহুমাত্রিক লেখিকা রাবেয়া খাতুন চার শতাধিক গল্প এবং পঞ্চাশটি উপন্যাস লিখেছেন। বিভিন্ন বয়সী পাঠকের জন্যই তিনি লিখেছেন অবিশ্রান্তভাবে। গল্প, উপন্যাস, কিশোর উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ কাহিনি প্রধান বিষয়। তিনি ছিলেন ভ্রমণ পিয়াসী। তবে এ-কথা সত্য যে, ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ অনেক থাকলেও তাঁর ভ্রমণ শুধুই ভ্রমণ ছিল না; তিনি যেসব দেশে গিয়েছেন সেসব দেশের কৃষ্টিকালচার, ঐতিহাসিক বিষয়সহ নৈসর্গিক বিচিত্র বিষয় এ দেশের পাঠককের সামনে সচিত্র উপস্থাপনও করেছেন। সাধারণ ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ থেকে একজন লেখকের ভ্রমণের জীবনকে হয়তো এভাবেই পৃথক করা যায়। তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্র ও বেশ কয়েকটি টিভি নাটক নির্মিত হয়েছে। ‘এই মেঘ এই বৃষ্টি’ সিনেমাটি জনপ্রিয় সিনেমা হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। উপন্যাসগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রয়েছে বেশ কয়েকটি। তন্মধ্যে ‘ফেরারী সূর্য’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তাঁর প্রথম উপন্যাস যেটি ছাপা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। এছাড়া ‘নীল নিশীথ’, ‘বাগানের নাম মালনি ছড়া’, ‘হিরণদাহ’, ‘মেঘের পর মেঘ’, ‘একাত্তরের নয় মাস’, ‘একাত্তরের নিশান’ তাঁর রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যান্য উপন্যাস।

 

ফেরারী সূর্য

প্রায় দেড়শ’ পৃষ্ঠায় মলাটবন্দি ‘ফেরারী সূর্য’ অধ্যায়বিহীন উপন্যাসের ক্যানভাসে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ঢাকা শহরের পাকসেনা ও রাজাকার বাকেরের অনেক নারকীয় ঘটনার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ভূমিকা বিধৃত হয়েছে। আখ্যানটি গড়ে উঠেছে কয়েকটি পরিবারের জীবনকে কেন্দ্র করে যাদের সবাই এদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করেছে। উনিশশ’ একাত্তর সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ঢাকা শহরের উত্থাল সময়ের কিছু ঘটনা গল্পের ভাঁজে ভাঁজে পাওয়া যায়। একাত্তরের মার্চের উত্তাপ উপন্যাসের শুরুতেই পাওয়া যায়।

উপন্যাসের স্থানিক পটভূমি ঢাকা শহর এবং উনিশশ একাত্তর সালের মার্চ থেকেই মূলত উপন্যাসের নির্মাণ শুরু। করিম সাহেবের পরিবারের তিন ছেলে খালেদ, আশেক ও আবেদ, খালেদের স্ত্রী বকুল, মেয়ে জাকিয়া ও মেয়ের জামাই ডা. রকীব, খালেদের ছেলে মিঠু এবং রাশা (মূল নাম রাশেদা), তার ভাই শরীফ ও রিপন, মা জেবুন্নেসা ও বাবা। এছাড়া দুটি গৌণ পরিবার দেখা যায় রমজানের পরিবার ও ময়নার মা। রাশার বাবা ও ভাই নিহত হওয়ার পর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঘটনাক্রমে আশেকের প্রেমিকা রাশা, তার মা ও রিপনকে করিম সাহেবের পরিবারেই থাকতে হয়। একইসঙ্গে কাজের বুয়া ময়নার মা ও কাজের ছেলে বাচ্চুও এই বাসার বাসিন্দা। এক অর্থে একটি বৃহৎ পরিবারের সদস্যদের কেন্দ্র করে উপন্যাসের কাহিনি নির্মিত। যদিও এই উপন্যাসে একই ধরনের চরিত্রের বেশ কয়েকটির  সমাবেশ থাকায় কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে আধিপত্য বিস্তারকারী এককভাবে কোনো চরিত্রই শক্তিশালী হয়ে চিত্রিত হয়নি তদুপরি উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত আশেকই কেন্দ্রে অবস্থান করছে। নারী চরিত্রের ক্ষেত্রে রাশা (রাশেদা), জাকিয়া ও বকুল তরুণদের মধ্যে ভরকেন্দ্রে, তবে জাকিয়া ও রাশার প্রতিপত্তি তুলনামূলক বেশি স্থান জুড়ে রয়েছে। এছাড়া পাড়ার ‘সবুজ সংঘে’র কয়েকটি চরিত্র খাঁটি দেশপ্রেমিক ও অকুতোভয় নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধাদের চরিত্রও চিত্রিত হয়েছে যাদের তারা হলো মামুন, মঞ্চুর, আব্দুল্লাহ, বাদল, ইকবাল। উপন্যাসের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো এই কিশোররাও যুদ্ধে জড়িয়ে যায়।

রকীব পেশায় ডাক্তার এবং সরকারি চাকরিজীবী, খালেদও সরকারি চাকরিজীবী। জাকিয়া ও একুশ বছর বয়সী বকুলও গৃহবধূ। পাকসেনাদের দোসর বাকের খান মোনাফেকের চরিত্র হিসেবে চিত্রিত। রাশাদের পরিবারে রাশা তরুণী হলেও পরিবারের মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। রকীব ডাক্তার ও সরকারি চাকরিজীবী হয়েও সস্ত্রীক কেন শ^শুর বাড়িতে থাকে তা পাঠকের মনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। এর সদুত্তর উপন্যাসে নেই।

আশেক ও রাশা ক্লাসমেট হলেও তাদের প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে এবং দুই পরিবারের সবাই হয়তো জানে অথবা জানে না। লেখক পাঠকের কৌতূহলের জন্য এই প্রেমকে প্রচ্ছন্ন রেখে দিয়েছেন। ক্র্যাকডাউনের রাতেই রাশার বাবা নিজ বাড়ির আঙিনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, পিতার বীভৎস লাশ স্বচক্ষে দেখেও নিজেকে স্থির রাখে রাশা, বাবার এই করুণ মৃত্যুর খবরটি মায়ের কাছে গোপন রাখে যাতে মা মানসিকভাবে ভেঙে না পড়েন। রাশার বড়ো ভাই শরীফ বেরিক্যাড দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় হাসপাতালে। কিন্তু রাশার পরিবার তার মৃত্যুর খবর জানতে পারে উপন্যাসের প্রায় শেষ ভাগে। কিন্তু দীর্ঘ সময় নিখোঁজ ভাই বেঁচে আছে এই প্রত্যাশায় ও প্রতীক্ষায় রাশাদের প্রহর কাটছিল। রাশার ছোট ভাই রিপন, সেও কিশোরদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধে যেতে চেয়েছিল কিন্তু তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হয়।

প্রায় দেড় শত পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে অধ্যায় বা পরিচ্ছেদ দ্বারা বিভাজিত নয়, সিনেমার পর্দায় চরিত্র যেভাবে আসা যাওয়া করে ঠিক তেমন দৃশ্যও এই উপন্যাসে দৃষ্ট হয় ফলে পাঠকের মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলতে হতে পারে। ঘটনার ঘনঘটা এবং অনেক চরিত্রের বিন্যাসে এই উপন্যাসের কাহিনি সংলাপশাসিত, চরিত্রগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি দিগি¦দিক ছুটছে এবং ঠাসাঠাসি ও গতিশীল কাহিনি হওয়াতে মনোযোগী পাঠক না হলে চরিত্রগুলোকে কখনো ছন্নছাড়া মনে হতে পারে, পাঠকের চোখের আড়ালে পড়ে যেতে পারে। ছোটো ও সরল বাক্যের সাবলীল ভাষায় রচিত।

কাহিনির ব্যাপ্তিকাল একাত্তর সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যদিও দিন তারিখের কোনো উল্লেখ নেই, অবশ্যই ফিকশনে দিন তারিখের উল্লেখ অনিবার্যও নয়, বাংলাদেশের ইতিহাস-সচেতন পাঠককুল ব্যাপ্তিকাল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বুঝে নিতে পারবেন। বলা বাহুল্য যে, ব্যাপ্তিকাল বিশ্লেষণের চেয়ে যুদ্ধভিত্তিক ফিকশনের সার্থকতা বিশ্লেষণ অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ।

‘ফেরারী সূর্য’ উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের একটি সম্পূর্ণ ফিকশন হিসেবে মান্যতা পেতে পারে। ৭ই মার্চের ভাষণের সামান্য উল্লেখ ছাড়া রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক ঘটনাবলির তেমন কিছু এই উপন্যাসে নেই; অবশ্যই তত্ত্ব বা তথ্য কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনাবলি কোনো ফিকশনের জন্য অপরিহার্য কোনো উপাদান নয়।

উপন্যাসের পটভূমি তৈরি করতে লেখক তেমন রং চড়াননি। বরং শুরুতেই তৎকালীন ঢাকা শহরে আগুনঝরা দিনগুলোর স্বাধীনতাকামী মুক্তিপাগল মানুষরা আন্দোলনমুখী, তাদের চিন্তা-চেতনায় যুদ্ধ ও স্বাধীকার আন্দোলনের আবহ অনুধাবন করা যায়। “ওরা দুজন পথের দুপারে থমকে দাঁড়ালো। মাঝে মার্চেরই কোনও ক্ষোভের শিকার এক জোড়া পোড়া গাড়ির বেরিকেড।”—উপন্যাসের প্রথম দুটি বাক্যের ছোট্ট প্যারাগ্রাফে পাঠকের বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, মার্চের শেষের দিকে এই ঘটনা, পাকসেনাদের চলার পথে বেরিকেড তৈরি করে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। ইতিহাস-সচেতন পাঠকরা অনুধাবন করতে পারেন এই ঘটনাটি ক্র্যাকডাউনের রাতে অর্থাৎ পঁচিশ তারিখ রাতে পাকসেনারা হামলা করতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে কোনো এলাকায় যুবসমাজ বেরিকেড তৈরি করেছিলেন যদিও তাতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু প্রতিরোধের চেষ্টা তো ছিল। সে রাতেই রাশার বাবা মারা যান, বড়ো ভাইকে মৃত পাওয়া যায় হাসপাতালের মর্গে। লেখক এই দুটি ঘটনা জুড়ে দিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির আভাস দিলেন। পাঠকও তৈরি হয়ে যায় যুদ্ধের দিনগুলো সম্পর্কে জানতে।

রবীন্দ্রনাথ, শহিদ মিনার ও বঙ্গবন্ধু এই তিন হলো পাকিস্তানিদের প্রধান শত্রু ও আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু। শহিদের রক্তে ছাপিয়ে যায় নগরের পাথর। কিন্তু যুদ্ধকে থামাতে পারে না। মুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যুকে গ্রহণ করে হেসে খেলে। আত্মরক্ষার ছলনাও চলে। রবীন্দ্র সংগীতের রেকর্ড ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে জিন্নার ছবি টানানো হয় ঘরে। বঙ্গবন্ধুর ছবিও লুকিয়ে রাখা হয়। দৃষ্ট হয় ইন্দিরা গান্ধীর তৎপরতা।

আশেক গেরিলা যোদ্ধা, সে ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে দলীয়ভাবে স্বাধীনতার জন্য গোপনে লড়ে যাচ্ছে। তাদের নেতৃত্বে ঢাকার বাইরে গ্রামেও একটি ক্যাম্প গড়ে ওঠে যেখানে যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আশেকের বড়ো ভাই খালেদ সরকারি চাকরিজীবী এবং সে মনে করত পাকসেনারা তার ক্ষতি করবে না। কিন্তু হায়েনাদের কাছে কে আপন আর কে-ই বা পর। একদিন বাসা এসে তল্লাসি চালাতে গিয়ে বকুলকে ধরে নিয়ে যায়। বকুলকে উদ্ধার করার জন্য আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রথমে তার অফিসের বসের সহযোগিতা চাইলে এখান থেকেই মানসিকভাবে পীড়ন শুরু হয়, বস পাঠালেন আর্মি অফিসারের কাছে। সেখানেও নিগৃহীত হয়। পরিশেষে বকুলকে ধর্ষণ করে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে যায়। হানাদারদের এ-রকম চরম বর্বরতা বকুল মেনে নিতে না পেরে সে আত্মহত্যা করে। খালেদও শেষের দিকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। নির্যাতনের পর বকুলকে বাসায় ফিরিয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি মর্মান্তিক ও পাঠকহৃদয়কে বিদীর্ণ করে।

খালেদ ছেলেমানুষের মতো চেচাতে চেচাতে নিচের দিকে ছুটলো। বকুলই। নখরাঘাতে ফালা ফালা, নিজের রক্তে মাখামাখি এক টুকরো মাংস। নগ্ন, কিন্তু প্রাণের স্পন্দনে তখনো উষ্ণ। ওকে পাঁজাকোলে তুলে খালেদ অবাক হয়ে দেখলো যে বকুলের জন্য পরিবারের উৎকণ্ঠার অন্ত ছিল না। এই মুহূর্তে তার পাশে কেউ নেই। তবে জুজুর ভয়ে যারা লুকিয়েছিল তাদের অনেকের জলজলে চোখের ফ্রেমে স্থির চিত্রের মতো এই মুহূর্তে তারা দুজন।

 

গায়ের শার্টে স্ত্রীকে আচ্ছাদিত করে সিঁড়ি ভাঙলো। প্যাসেজ শূন্য পেলো। সোজা ঢুকলো বাথরুমে। হ্যাঙ্গারে ধোয়া চাদর, তোয়ালে, সাবান, ডেটল সাজিয়ে রেখে গেছে কেউ।

হানাদারদের কাছে তখন মেয়েরা এমনই ছিল খেলার পুতুল। তাদেরকে ধরে নিয়ে যেত এবং অমানুষিক নির্যাতন করে আবার কখনও ফিরিয়ে দিত, কখনও ক্যাম্পে রেখে দিত। যুদ্ধের শেষে কেউ ফিরে এসেছিল, অনেককেই হত্যা করা হয়েছে, কেউ কেউ গর্ভধারণ করে ফিরলেও পরিবারে তাকে স্থান দেওয়া হয়েছে, অথবা হয়নি। আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসেও খালেকের স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নির্যাতনের পর ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে একই রকম ঘটনা লক্ষ করা যায়।

মহল্লার বাকের খান, এন্টিপ্রোটাগনিস্ট চরিত্রটি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য উপন্যাসে রাজাকার বা পাকিস্তানি দোসরদের চরিত্রগুলো সাধারণত মোল্লা জাতীয় মানুষগুলোই উপস্থাপিত। অবশ্যই তখন মোল্লারাই তাদের ঘনিষ্ট ও সর্বোৎকৃষ্ট বন্ধু ছিল। কিন্তু বাকের খান ছিল আধুনিক শিক্ষিত ও ধূর্ত প্রকৃতির মানুষ। তার ছেলেকে আবার আশেক মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছে। তার শকুনে চোখের নজরদারির আওতায় আশেক ও রাশাদের পরিবার। আর্মি অফিসারদের সঙ্গে তার মেলামেশা এবং তাদের খুশি করার জন্য গোপনে তথ্যতালাশ দিয়ে সহায়তা করে। এরই নমুনাস্বরূপ, একদিন রাশাকে অপহরণের জন্য এক আর্মি অফিসার নিয়ে আসে রাশাদের বাসায়। রাশাকে অপহরণের সময় আশেক ওদেরকে আক্রমণ করে রক্ষা করে। দৃশ্যটি সিনেমাটিক।

বাড়ির কাজের ছেলে কিশোর বাচ্চু ক্রমাগত দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে। সে বিভিন্নভাবে গোয়েন্দাগিরিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বড়ো ধরনের সহযোগিতাও করে। একটি ব্যাংক লুটের সময় তার সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। আর সর্বশেষ পরিচয় পাওয়া ওর নেতৃত্বে বাড়ির  শিশুরা রিপন, মিঠু, ময়না একদিন উধাও। দূরের কোনো গ্রামের এক কৃষকের বাড়ি থেকে রিপন, মিঠু ও ময়নাকে উদ্ধার করা গেলেও বাচ্চু শহিদ হয়।

উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে টর্সার সেলের নির্মম ও অমানুষিক নির্যাতনের দৃশ্য। মেয়েদেরকে বন্ধ্যা করে দেওয়ার জন্য এদেশের ডাক্তারকে বাধ্য করা হয়। নিরুপায় ডাক্তার মর্মপীড়ায় আক্রান্ত হয়। মামুন এই উপন্যাসের একটি দুর্দান্ত ও স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র। সে একদিন ধরা পড়ে টর্সার সেলে নির্যাতিত হয়। তার নির্যাতনের দৃশ্যকল্প অবর্ণনীয়, পাঠকের হৃদয় বিগলিত হতে পারে। এসব ঘটনা ছাড়াও যুদ্ধের সময়কার অনেক বাস্তবচিত্র উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে; যেমন- পাকসেনাদের লুটতরাজ, বিহারিদের আগ্রাসন, পথেঘাটে খ-িত বীভৎস লাশের বর্ণনা ইত্যাদি।

রাশাদের পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েনের বর্ণনাও উপন্যাসে উঠে এসেছে। রাশার মা, রিপন এই তিনজনের পরিবারে যেন বেঁচে থাকাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

ডা. রকীব, জাকিয়ার স্বামী যে হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা করে আবার গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে। একদিন তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গুলিতে ঝাঝরা করে ফেলে।

জাকিয়া গর্ভবতী। স্বামী শহিদ হয়েছে। পিতৃহীন অনাগত শিশুর অপেক্ষা পুরো পরিবার। একটি শিশু যেন স্বাধীনতার প্রতীক। দেশও একদিন স্বাধীন হয়ে শিশু-রাষ্ট্রের জন্ম হবে সেই প্রতীক্ষাতে সবাই উদ্বিগ্ন।

অবশেষে আটমাসে জাকিয়া এক শিশুসন্তান প্রসব করে। রাশা শিশুটিকে জাকিয়ার কোলে দেয়। তারপর দেশও স্বাধীন হয়। শিশুসন্তান জন্মের প্রতীকী গৌর কিশোরের ‘প্রেম নেই’ উপন্যাসে দেখা যায়। অবশ্যই সেই উপন্যাসে মৃতু সন্তান প্রসবের মধ্য দিয়ে সাতচল্লিশের দেশভাগের একটি আশাহত প্রতীক প্রকাশ করা হয়েছে। রিজিয়া রহমানের ‘রক্ষের অক্ষর’ উপন্যাসে নিষিদ্ধ পল্লিতে এক যৌনকর্মীর শিশুসন্তান প্রসবের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিণতি দেখা যায়। এই প্রতীকী শিশু একটি স্বপ্নের, একটি সম্ভাবনাময় সূর্যোদয়ের প্রতীক যার মাধ্যমে যৌনকর্মীদের মুক্তির সম্ভাবনা পরিস্ফুটিত হয়।

রাবেয়া খাতুনের উপন্যাসের নির্মাণকলা বৈচিত্র্যহীন একই ধারার। তাঁর মুক্তিযুদ্ধের আরও তিনটি উপন্যাস পড়ার সুযোগ হয়েছে বর্তমান লেখকের। তিনি অধ্যায়ের বিভাজন না করে টানা গদ্য লিখে যান, স্বল্প পরিসরের ন্যারেশনের চেয়ে সংলাপপ্রধান হয়ে উঠেছে তাঁর উপন্যাসগুলো। গল্পের ভেতর থেকে চরিত্রগুলোকে পাঠককে খুঁজে নিতে হয় বলে অসতর্ক পাঠক কোনো চরিত্রগুলোর মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপন বা কোনো ঘটনা হারিয়ে ফেলতে পারেন যদিও চরিত্রগুলো সফলভাবে চিত্রিত হয়েছে। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি উপন্যাস ‘বাগানের নাম মালনিছড়া’ একটি ক্ষুদ্র পরিসরের, শাস্ত্রমতে বলা চলে উপন্যাসিকা। এই গল্পে একাত্তর সালে পাকবাহিনী এবং তাদের দোসরদের লুটতরাজ, হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর পোড়ানোর যে ধরনের হাজার হাজার বীভৎস ঘটনা ঘটেছিল তারই একটি খ- চিত্র এই উপন্যাসে প্রক্ষেপিত হয়েছে আকর্ষণীয় গল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে। গল্পের বর্ণনা সহজ-সরল প্রাঞ্জল ভাষায় হলেও প্রতিটি বাক্যই যে সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত বিন্যাসে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করে গল্পের পরিণতি ঘটানো হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই উপন্যাসের কাহিনি ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ থেকে যাত্রা শুরু এবং প্রথমেই যুদ্ধের ডামাঢোলের শব্দে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে যায় উপন্যাসের শুরুতেই। পারিবারিক আবহে উপন্যাসটি নির্মিত হলেও মূল ঘটনার স্থানিক প্রেক্ষাপট সিলেটের চাবাগান।

‘নীল নিশীথ’ নাতিদীর্ঘ আরেকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। কাহিনির ভেতরে যদিও জলো আবেগ রয়েছে কিন্তু লেখার ক্ষুর সেই জলো আবেগের মেদকে এমনভাবেই অপসারণ করে নিরেট গদ্যভাষায় একটি অ্যাস্ট্রাক্ট পোয়েট্রেট অঙ্কিত হয়েছে যা পাঠকের মনে স্থায়ী শিল্পের স্থান দখল করে। উপন্যাসের ক্যানভাসে লেখক নানামাত্রিক ও বিচিত্র রং চড়িয়ে সূক্ষ্ম আঁচড়ে কাহিনি নির্মাণ করেছেন যে উপন্যাস পাঠে পাঠক অসতর্ক হলে ছিঁড়ে যেতে পারে গল্পের বাঁধন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *