এসকর্ট: আবদুলরাজাক গুরনাহ’র গল্প
ভাষান্তরঃ পারভেজ আহসান
বোধ হয় সে আমাকে আসতে দেখেছিল । ব্যক্তিগত কারণে সে ইশারা দেয়নি । গাড়ির পেছনের দরজার কাছে আমি দাঁড়ালাম । খবরের কাগজটি ভাঁজ করে আমার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে গাড়ীর দরজাটি খুলল । আমি বিস্ময়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম । এটি আমার প্রতি বিরক্তি নয় । বরং এটি হচ্ছে অস্থিত্বের সংকট থেকে জন্ম নেয়া এক ধরণের অনিবার্য হতাশা ও বিরক্তিবোধ । সে জানতে চাইল আমি কোথায় যাব । আমি হোটেলের নাম বলতেই সে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল । তার পাশে একটি সিটে বসলাম । সেও বুঝতে পারল বিরক্তি বোধ করার মতো তেমন ব্যক্তি আমি নই ।
গাড়িটা ভীষণ জরাজীর্ণ ছিল । সিটটি শক্ত পিণ্ডের মতো । সিটের কোণাগুলো কাঁচা চামড়ার মতো কুঁচকানো । ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে মোড় নেয়ার সময় সিটের একটি ধারালো কোণা শার্টের ভেতর দিয়ে আমাকে খোঁচা দিচ্ছিল । দুপুরের খাবারের সময়ে অধিক যানবাহনের ভীড়ে আস্তে আস্তে গাড়ি চলার কারণে হাটুর উপর রাখা আমার ব্রিফ কেসের দিকে সে তাকাল । গলার স্বর পরিবর্তন করে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘ কোত্থেকে এসেছ ?’ পশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যে আমি তার দিকে তাকালাম । তার মুখে ক্রোধ ও যন্ত্রণার ছাপ দেখে বুঝতে পারলাম সে খুব বিপদের মধ্যে আছে । আমি ভীষণ ভয় ও বিরক্তি বোধ করছিলাম । সে আমার কেইসের দিকে তাকিয়ে একটি মুচকি হাসি দিল । আমার কেইসের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে আবারো বলল, ‘ কোত্থেকে ? ’আমি বললাম,‘ ইউনিগারেজা, ইংল্যান্ড ।’ আমি খুব ন¤্রভাবে কথা বলছিলাম । আমি যে তার সাথে কথা বলতে মোটেও আগ্রহী নই তা বুঝানোর চেষ্টা করছিলাম । সে আবারো বলল, ‘ তুমি কি ছাত্র ? ’ সে ভেবেছিল আমি সমৃদ্ধির জন্যে এখানে এসেছি আর বাড়ি ফিরব কিছু স্মৃতি ও একটি সস্তা ব্রিফকেইস নিয়ে ।
‘ না , আমি একজন শিক্ষক ,।
দুপুরের খাবারের সময় মানুষেরা খুব তাড়াহুড়ো করছিল ।একদল ভারতীয় স্কুল বালক প্রাণবন্তভাবে গল্প করছিল, তারা বাঁশি বাজাচ্ছিল । রাস্তায় ছুটন্ত গাড়িকে তোয়াক্কা না করেই তারা রাস্তা অতিক্রম করছিল। গাড়ী চলাচলের জন্যে ড্রাইভারকে হর্ন বাজাতে হচ্ছিল । পোস্ট অফিসের কাছে যানযট লেগে থাকে । অসংখ্য মানুষ ফুটপাত দিয়ে চলাচল করে । টাই ও শার্ট পরিহিত কিছু মানুষ তড়িঘরি করে ছুটে যাচ্ছিল । ব্যস্ততা ,শুধুই ব্যস্ততা ।আমার হোটেলের কাছে রেল টার্মিনালের দিকে মোড় নেয়ার সময় গানের সুরে সে ‘ইউনিগারিজা ’ শব্দটি উচ্চারণ করল । সে আবারো বলল, ‘ ইউনিগারিজা , বিলাসিতার এক জায়গা ।’ ‘ তুমি কি কখনো সেখানে গিয়েছ ?’ আমার এ প্রশ্নে ছিল এক বিষ্ময়কর অবিশ্বাস । ঠিক সেই সময়ে গাড়ি চালক রাস্তা থেকে পানি বিক্রোতার গাড়িকে সরানোর জন্যে হর্ন বাজাচ্ছিল । কিছুক্ষণের জন্যে পানি বিক্রোতার সাথে ঝগড়া , চিৎকার চেঁচামেচি ও জানালার বাইরে হাত নাড়ানোর মধ্যেই নিমগ্ন ছিল লোকাটি । আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,‘ ইংল্যান্ডে কি তোমার কোন আত্মীয়-স্বজন আছে ?’ আমি কল্পনা করতে পারিনি যে ব্যক্তি একটি লক্কর ঝক্কর গাড়ি চালাচ্ছে সে সেখানে যেতে পারে। ‘ আমি তো সেখানে থাকতাম । ’ এ কথা বলে সে আমার দিকে তাকল এবং হাসল । আমরা তখন প্রধান সড়ক ছেড়ে রেল গুদামের পিছন দিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় বড় বড় গর্ত এবং রেল লাইনের কারণে তাকে গাড়ী চালানোয় মনোযোগ দিতে হচ্ছিল । সে কিছু একটা বলতে চাইল । খারাপ রাস্তার কারণে গল্পটি শুরু করতে পারছিল না । কিছুক্ষণ পর, সে বলা শুরু করল , ‘ এক মালয়া অর্থাৎ ইউরোপিয় এক পতিতার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল । সে আমাকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স , এমনকি অস্ট্রেলিয়াতে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল । । তুমি মানুষের কাছ থেকে হয়তো এদের গল্প শুনেছ । তুমি মনে মনে ভাবতে পার তারা মিথ্যে বলছে । মালয়া মহিলার সাথে সম্পর্ক না হওয়ার আগ পর্যন্ত আমিও তাই ভাবতাম ।’ ঠিক সে সময়ে গাড়িটা হোটেলের সামনে থামল । তারপর স্মৃতি আস্বাদনের প্রসন্নতা ছড়িয়ে পড়ল তার মুখ জুড়ে । ‘ আমার নাম সেলিম । আমি সবসময় পোষ্ট অফিস টেক্সি স্ট্যান্ডে থাকি । ’ এ কথা বলে সে চলে গেল ।
আমি অপ্রত্যাশিতভাবে এই হোটেলটি পেয়েছিলাম । ইমিগ্রেশন অফিসার বলল এ দেশে কোন ঠিাকানা না দিলে সে প্রবেশ অনুমতি দিতে পারবে না । পাসপোর্টে আমার জন্মস্থান জানজিবার নামটি দেখে বিনয়ের সাথে সে এ কথাটি বলেছিল । জানজিবারে তার আত্মীয়-স্বজন রয়েছে । সে অনেকগুলো হোটেলের ঠিকানা দিয়েছিল । সেখান থেকে এ হোটেলের ঠিকানা পেয়েছিলাম ।
পরের দিন সন্ধ্যায় ভিজিটর আসায় রিসিপশনিস্টের কল পেয়ে বিস্মিত হলাম ।মনে মনে ভাবলাম সেলিম ছাড়া আর কেউ নয় । আমি কখনো ভাবিনি সে এখানে আসতে পারে । ঠিক তাই হল । সাদা ফুলের প্রিন্ট করা সবুজ সিল্কের কাপড় দিয়ে বানানো জামা এবং জিন্স প্যান্ট পরে অপেক্ষা করছিল সেলিম । সে আমার জন্যে এক বোতল পানীয় কেনার ইচ্ছা প্রকাশ করল এবং ক্রয় করল । সে সময় বারটি খালি হয়ে গিয়েছিল । কেবল এ হোটেলের মালিক , এক বেলজিয়াম দম্পতি ও তাদের বন্ধুু ছাড়া আর কেউ ছিল না । সিল্কের শার্ট এবং নীল জিন্সের প্যান্ট দেখিয়ে বলল তার ‘মালয়া’ এগুলো কিনে দিয়েছিল ।সে বলল,‘ তুমি কি জানতে চাও কীভাবে আমি তাকে পেয়েছি ? আমি সম্মতি দেয়ার সাথে সাথে সে বলা শুরু করল,‘ উত্তর উপক‚লে টামবিল হোটেলের বাইরে সে কারো জন্যে অপেক্ষা করছিল ।প্রবেশমুখের কাছে একটি গাছের নিচে আমি তাকে দেখতে পাই । তখন তার কাছে যাই । কথা বলি । এক পর্যায়ে সে আমার গাড়িতে উঠে পড়ল । তাকে নিয়ে সারাদিন গাড়িতে চালাম । সন্ধ্যায় তাকে হোটেলে ফিরিয়ে দেয়ার সময় সে আমাকে সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যায় । প্রত্যেকদিন অন্ধকারে সমুদ্র সৈকতে আমরা অন্তরঙ্গ হয়ে পড়তাম ।
আমি অনিচ্ছাকৃতভাবে বললাম ,‘ সমুদ্র সৈকতে তুমি খুব ভাল সময় কাটিয়েছ ।’ । আমি তার পানীয় দ্রব্যের মূল্য পরিশোধ করলাম । তার স্বামীর সাথে তালাক হওয়ায় সে ভাল অংকের টাকা পেয়েছিল । সেই টাকা দিয়ে সে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল । সে তার জন্মস্থান লিভারপুলে সেলিমকে নিয়ে গিয়েছিল । সে তাকে খুব ভালোবাসত । তারা দু’জনে বিলাসী জীবনযাপন করছিল ।তারপর চিঠি লেখার কথা বলে আসি সেখান থেকে চলে গেলাম ।
পরের দিন সন্ধ্যায় সে আবারও আসল । আমি হোটেলে নেই তা জানিয়ে দেয়ার জন্যে রিসিপশনিস্টকে বলেছিলাম । আনুগত্যের কারণে তাকে এ কথাটি বলতে পারে নি । তার শার্টটি দেখিয়ে বলল, ‘ আমি এ শার্টটি অস্ট্রেলিয়া থেকে কিনেছি । আমরা কিছুদিন ফ্রান্সে থাকার পর সেখানে গিয়েছিলাম । তার নাম বেট্টি। বেথনি হচ্ছে একটি ধর্মীয় নাম । কিন্তু সে বেট্টি হিসেবে পরিচয় দিত । ’ পরের দিন সে আমাকে অন্য একটি ক্লাবে নিয়ে গেল । সেখানে গিয়ে সে কিছুটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিল ।
ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে আমার হাতে মাত্র দু’দিন সময় ছিল । সেলিম আসার আগেই আমি প্রস্তুত ছিলাম । সে গাড়ী ছেড়ে দিল । কিছুক্ষণ পর আমি বুঝতে পারলাম সে মূল রাস্তা ছেড়ে অন্য পথদিয়ে যাচ্ছে । এটি একটি মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা ছিল । আস্তে আস্তে চারপাশ অন্ধকারে ডুবে গেল । রাস্তার দু’পাশে ছিল ঝোপঝাড় । দীর্ঘক্ষণ চলার পর এক সাথে চার-পাঁচটি ঘর দেখা গেল । সে গাড়িটি থামাল । ঘরগুলোতে কেরোসিনের প্রদীপ জ্বলছিল । সেখানে মজিদ ও বুড্ডা নামের দুই ব্যক্তির সাথে পরিচয় করে দিল । কিছুক্ষণ পর এক মধ্যবয়সী মহিলা এসে হাজির হল ।তাদের সাথে মজার গল্প বলার পর খাবার তৈরীর জন্যে সে চলে গেল । টেবিলের উপর কয়েকটি ওয়াইনের বোতল পড়েছিল । আমি অন্যরকম এক পরিবেশ আন্দাজ করতে পারলাম । ভেতরের রুম থেকে দুটো বিয়ারের ক্যান নিয়ে ছেঁড়া জামা পরিহিত একটি মেয়ে এসে হাজির হল । তার চোখে কোন ভাষা নেই । কেবল ধূ-ধূ প্রান্তর । মেয়েটি পেছনের কক্ষে যাওয়ার সময় মজিদ তাকে অনুসরণ করল । হঠাৎ মেয়েটির চিৎকারে কেরোসিনের প্রদীপ কেঁপে উঠল । আমি সেখানে আর থাকতে চাইলাম না । সেখান থেকে সেলিম আমাকে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে গেল । ঢাক-ঢোল বাজিয়ে কনে বাড়িতে বরের আগমনের দৃশ্য উপভোগ করলাম ।কনের দিকে তাকিয়ে সেলিম বলল,’‘সে আমার স্ত্রী’র এক আত্মীয়া ’‘ বেথনির সাথে পালিয়ে যাওয়ার আগে কি তুমি বিয়ে করেছিলে ?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ , অনেক আগে আমি বিয়ে করেছিলাম । আমি কোন নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে পারতাম না । কেবল রক্তপাত হতো’‘ তুমি কি ডাক্তারের কাছে গিয়েছ ? ’ ‘ কিসের ডাক্তার ? এখানে কোন ডাক্তার নেই ।’ লাজুক কন্ঠে সে বলল , ‘ আগামীকাল তুমি কি আমাকে নিয়ে যাবে? আমি সেখানে ডাক্তার দেখাব । তুমি যা চাও আমি তাই করব’
আমি পরের দিন নিজেই এয়ারপোর্টে চলে যাব এ কথা জেনেও সে পরের দিন আসল । গাড়ি পার্ক করে সে আমার আমার পাশে হাঁটাহাঁটি করছিল । সে বলল , ‘আবার এসে আমাকে নিয়ে যাও । এ ক্ষেত্রে কতো টাকা লাগবে ? আমি সকল খরচ পরিশোধ করব। ’
আমি সেই দেশের মুদ্রার একটি প্যাকেট তুলে দিলাম । সে বিষ্ময়বোধ করল । আমি বললাম , ‘ তুমি এই টাকা দিয়ে ভাল কিছু করতে পারবে । ‘পরবর্তীতে এসে তুমি দীর্ঘদিন থাকবে ’- এ কথা বলে সে চলে গেল ।