মোজাম্মেল হক নিয়োগী
রশীদ হায়দার কথাসাহিত্যিক ও গবেষক হিসেবে পরিচিত। সম্পাদনাসহ মোট ১৫টি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। তাঁর সম্পাদনায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতি ’৭১ নামে ১৩ খন্ডে গ্রন্থ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা খাঁচায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে এবং অন্ধ কথামালা ১৯৮০ সালের রোববার ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালের জুন কলকাতার ডি.এম. লাইব্রেরি প্রকাশনা থেকে। বাংলাদেশে বেরোয় ১৯৮৭ সালে। পরবর্তীকালে দুটি উপন্যাস এক মলাটে ‘খাঁচায় অন্ধ কথামালা’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ‘খাঁচায়’ মুক্তিযুদ্ধের শেষ তেরো দিনের ঢাকার যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রচিত প্রায় শত পৃষ্ঠার একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস। অন্ধ কথামালা মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক দিকের প্রেক্ষাপটে রচিত। এই প্রবন্ধে সত্তর দশক পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সীমিত করে দেওয়ায় একই মলাটে দুটি উপন্যাস থাকলেও ‘অন্ধ কথামালা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
ধানমন্ডি লেকের উত্তর পাশে মিরপুর রোডে একটি তেতলা বাড়ি উপন্যাসের পটভ‚মি। এই বাড়িতে জাফররা খিলগাঁও থেকে উনিশ শ একাত্তর সালের সেপ্টেম্বর মাসে এসেছে। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলোর প্রথম পৃষ্ঠাতেই তাস খেলার মধ্য দিয়ে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তারা একই বাড়ির বিভিন্ন তলার বাসিন্দা এবং তাদের মিথস্ক্রিয়ায় আখ্যানের নির্মাণের ভিত্তি রচিত হয়ে ছয়টি অধ্যায়ে যুদ্ধ বিজয়ের সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে খাঁচায় বন্দি টিয়ে পাখিকে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে আনন্দোচ্ছাসের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। একাত্তর সালের স্বাধীনতার দু-তিন মাস আগে থেকে যুদ্ধের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল না, তাদের ছিল অখন্ড অবসর। সারা দেশেই তখন চাকুরেরা অফিস-আদালত বর্জন করেছে, কৃষকরা গা ছাড়া ভাব নিয়ে কৃষিকাজ করে, ব্যবসায়ীরাও ভয়ে-আতঙ্কে ইচ্ছেমতো অনিয়মিত দোকানপাট খোলে, ছাত্রছাত্রীরা ছুটি কাটায়Ñ মনে হয় সবাই স্বাধীন দেশের নতুন সূর্যটি দেখার অপেক্ষা করছিল। ইনডোর গেম, বিশেষ করে তাস, ক্যারম বোর্ড, লুডু ইত্যাদি খেলা খেলে এবং ট্রানজিস্টার, রেডিওতে খবর শুনে দিনাতিপাত করা ছিল তখনকার অনেক মানুষের প্রধান কাজ। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো তাস খেলায় সময় নিকেশ করার চিত্রটি যথার্থভাবে ফুটে উঠেছে। ভূমিকাপর্বে লেখকের ভাষ্যমতে, স্বাধীনতার ঊষালগ্নে, তেরো দিনের সময়সীমায় কাহিনি বর্ণিত। সে হিসাবে আখ্যানের সূত্রপাত ৩রা ডিসেম্বর থেকে, যে সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা অকুতোভয় বীর মুক্তিসেনাদের যুদ্ধকৌশলে ও আক্রমণে পাকহানাদার বাহিনী পর্যুদস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে ঢাকামুখী হয়েছিল। তখন সারা দেশের উৎকণ্ঠিত মানুষ স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যটি দেখার জন্য মুখিয়ে ছিল। এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ শোনার জন্য রেডিও, ট্রানজিস্টারের সামনে উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষার প্রহর গোনে। জাফর, তার তেইশ বছর বয়সী সুন্দরী স্ত্রী লিলি, শিশুকন্যা শর্মিষ্ঠা ও কাজের মেয়ে ময়নাকে নিয়ে জাফর খিলগাঁও আনসার ক্যাম্পের পাশ থেকে কিছুটা নিরাপত্তার জন্য মিরপুর রোডের বাসায় চলে আসে। ওখানে ডাক্তার আজিজুর রহমানের স্ত্রীকে অপহরণ করার পরই তারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসে। ওখানকার বুলডগের মতো বেলুচ কর্নেল ইকবাল আহমদ ও তার বাহিনীর শ্যেনদৃষ্টি থেকে লিলিকে রক্ষা করার জন্যই নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা। জাফরের ছোট ভাই স্কুলপড়–য়া, সে-ও মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে। খিলগাঁওয়ের তরুণরা বাসায় ছাপাখানা বসিয়ে বিভিন্ন ধরনের লিফলেট ছাপিয়ে বিতরণ করে। জুলাই মাসে যাতে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পরীক্ষা না দেয়, সে জন্য গোপনে চিঠিও বিলি করে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচজন নিরপরাধ তরুণকে পাকসেনারা নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই কাজগুলো করা হচ্ছিল জাফরদের ভাড়া বাসার একটি রুম থেকে। বাড়িওয়ালার ছেলে লুৎফরও গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা।
দালাল সব জায়গায় ছিল। খিলগাঁও এলাকায় এমন এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বাদলের পরিচয় পাওয়া যায়। লিলির বড় ভাইকে দালাল বলে সন্দেহ করা হলেও তার প্রমাণ লেখক দাঁড় করাননি। হয়তো এটি একটি সাসপেন্স।
যুদ্ধের সময় সামাজিক কাজকর্ম, বিয়েশাদি ইত্যাদি বন্ধ ছিল না। ভারতের ক্যাম্পেও বিয়ে হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশেও ছিল, এই উপন্যাসেও লিলির ভাইঝি রওশনের সঙ্গে ডা. হাদীর বিয়ে হলো। তা-ও আবার ঢাকার ধানমন্ডির মতো জায়গায়। রওশনের বিয়ে এবং লিলির দুই ভাইপোর মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা, নকশালদের অত্যাচার ইত্যাদি ঝক্কিঝামেলা থেকে মুক্ত থাকার জন্য কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় এসে ওঠে জাফরের বড় বোনের সেই মিরপুর রোডের তেতলা বাড়িতে। এই উপন্যাসে নকশালদের স্বাধীনতাবিরোধী ভ‚মিকা, পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজাকারদের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অস্বীকার করার উপায় নেই, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও বেশ কয়েকটি গ্রুপ ছিল, অনেকে ভারতে প্রশিক্ষণ না নিয়ে দেশে থেকেই নিজেদের বাহিনী গড়ে তুলেছেন; যেমন কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী ইত্যাদি। আবার চীনপন্থীরা প্রথমে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিলেও পরে নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। কিছু নকশালপন্থী, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী সরাসরি হানাদারদের পক্ষে কাজ করে, অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যাও করেছে। ‘একটি কালো মেয়ের কথা’ উপন্যাসেও চীনপন্থীদের ভূমিকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
মিরপুর রোডের তেতলা বাড়ির বিভিন্ন ফ্লোরের বাসিন্দাদের মধ্যে টান টান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, যখন আকাশ কাঁপিয়ে গুলির শব্দ ও আলোর ঝলকানি দেখতে পেল। ভারতের বিমান হামলাও শুরু হয়েছে। জাফর, তাহের, মন্টুসহ কয়েকজনের মধ্যে কথোপকথন, যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। স্মৃতিচারণে পঁয়ষট্টি সালের ভারত পাকিস্তানের বিশ্লেষণও তাদের আলোচনায় স্থান পায়। রেডিও খুলে বসে, খবর শুনে বিবিসি। শহরের চরম উত্তেজনা। সাইরেন বাজছে। আলবদর বাহিনীর কর্মীরা প্রচার করছে, ভারতের ছয়টি বোমারু বিমানকে ভূপাতিত করা হয়েছে। এটি বাড়িয়ে বলা হচ্ছে, তা বুঝতে পারে উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা। তবে সেদিনকার আলবদর বাহিনীর সদস্যদের কর্মতৎপরতা বিধৃত হয়েছে। সেই সময়ের আলবদরের পান্ডা চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে দেখানো হয়েছে, এ সম্পর্কে আমরা পরবর্তীকালে জানতে পারি যে, ১৯৭১ সালে জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা অনুযায়ী একাত্তর সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত আলবদর বাহিনীর চিফ এক্সিকিউটর ছিল আশরাফুজ্জামান খান এবং চৌধুরী মঈনুদ্দিন ছিল সেই পরিকল্পনার অপারেশন ইনচার্জ। এই হত্যাকান্ডের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার মৃত্যুদন্ডের রায়ও হয়। যুদ্ধের পর যুক্তরাজ্যে পালিয়ে গিয়ে নাগরিকত্ব লাভের কারণে রায় কার্যকর সম্ভব হয়নি। লেখকের ভাষায় তার পরিচয় পাওয়া যায়:
ফিরে আসছে আলবদরের জিপ। আবার সেই ঘোষণা; কণ্ঠে বিজয়োল্লাস; জিপ যেন মিগ-এর গতি পেয়েছে। জিপটা যখন জাফরের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, অবাক হয়ে সে দেখে সামনের সিটে মাউথপিস হাতে নিয়ে পল্টনের মাঠে বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গিতে চৌধুরী মঈনুদ্দিন, দাড়ি-গোঁফে ঘেরা সুন্দর মুখের উত্তেজনা টগবগ করছে, গত পরশুও জাফর তাকে পূর্বদেশ পত্রিকা অফিসে কাজ করতে দেখেছে। মন্টুকে বললো, মন্টু, ছেলেটাকে চিনলে?
আরে! ইসলামী ছাত্র সংঘের বিরাট পান্ডা। [খাঁচায়, পৃ. ৫১]
স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে নভেম্বরের শেষের দিক থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকা পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারমুক্ত হওয়ার খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণে শুধু মিরপুর রোডের ওই বাড়িতেই টান টান উত্তেজনা ছিল না; তা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। সারা দেশের চিত্রই মূলত প্রতিফলিত হয়েছে এই উপন্যাসে। কিন্তু আলবদর বাহিনীর গুজব প্রচারের ফলে অবাঙালি যারা বিহারি হিসেবে পরিচিত, তারা মনে করেছে, ইন্ডিয়া পাকিস্তানিদের হাতে চুড়ান্তভাবে মার খেয়েছে। মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের বিহারি-অধ্যুষিত এলাকায় উল্লাস করে, মিষ্টিও বিতরণ করে।
কিন্তু বিধি বাম। বিহারিদের উল্লাস ছিল বড়ই ক্ষণস্থায়ী। ভারত, ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী ঢাকা ঘিরে ফেলে। তাদের মুখ চুপসে যায়- পরদিন থেকে থেকে জেনারেল স্যাম ম্যানেকশর বার্তা প্রচারিত হতে থাকে আকাশবাণী থেকে: জেনারেল রাও ফরমান আলী, অস্ত্র পরিত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করুন; হাতিয়ার ডাল দো। [তদেব, পৃ. ৭৭]
একাত্তরের যুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন ফিকশন থেকেও জানা যায়, পাঠান ও বেলুচ সৈনিকরা এ দেশে খুব নির্যাতন করেনি। ইমদাদুল হক মিলনের ‘জীবনপুর’ উপন্যাসে বাঙালিদের প্রতি রীতিমতো এক বেলুচ সৈনিকের ভালোবাসা প্রকাশ পায়। এই উপন্যাসেও এক ক্যাপ্টেনের তার শিশুকন্যার প্রতি ভালোবাসার আবেগঘন কান্না পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। ঘটনাচক্রে ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক জাফরদের বাসায় এসে শর্মিষ্ঠাকে দেখে। শর্মিষ্ঠার মতো ক্যাপ্টেন ইশতিয়াকের একটি মেয়ে রয়েছে, তার নাম রাশিদা ইশতিয়াক। শর্মিষ্ঠাকে বুকে তুলে নেয় ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক। তারপর কাঁদতে কাঁদতে শূন্য রাস্তায় বের হয়ে যায়। আরও এক পাঠান সৈনিক নিউমার্কেট থেকে মেয়ের জন্য জামা কেনার ঘটনাও পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক জানায়, তাদের এ দেশে পাঠানো হয়েছে কাফের ও হিন্দুদেরকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু তারা জানত যে মুসলমানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছে।
এই আখ্যান কল্পকাহিনি বা ফিকশন। হয়তো লেখকের শ্রত কিংবা প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা থাকলে থাকতেও পারে, কিন্তু সেটি ধর্তব্য নয়। ফিকশন হিসেবে এই উপন্যাস মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। যুদ্ধ-সাহিত্য ও ঐতিহাসিক উপন্যাসে তথ্যের মিশ্রণ উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করে। এই উপন্যাসেও তথ্যের মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যাদের ধারণা আছে, তারা সবাই জানেন, পাকিস্তানের বিজয়ের জন্য আমেরিকা বিভিন্ন সহযোগিতা দিয়েছে এবং সর্বশেষ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে। ওই সময় অনেকের কাছে এটি ছিল একটি আতঙ্কের বিষয়। সেই মুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ বহির্বিশে^র বিষয়গুলো লেখক বর্ণনা করেন-
সপ্তম নৌবহর। রাশিয়ান ফ্লিট। চীন কি করবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বৃটেন ফ্রান্স এখনো নিশ্চুপ। কোনো দরকার নেই কোনো মহাশক্তির সাহায্যের। তার চেয়ে নেমে আসুক কোনো অলৌকিক ঘটনাবলি, উদ্ধার করে নিয়ে যাক খাঁচায়-পোরা এই অসহায় মানুষগুলোকে। জাফর ভাগ্যের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে একসময় অনুভব করে, তার সমস্ত শিরা-উপশিরা টনটন করছে।
আকাশবাণী বলে ওঠে,
ঢাকা এখন আমাদের লক্ষ্যসীমার মাঝে এসে গেছে। [তদেব, পৃ. ৯৫]
দেশ স্বাধীন হয়। আনন্দের জোয়ারে সারা দেশ ভেসে গেলেও যারা স্বজন হারিয়েছিল, তাদের অন্তরে বয়ে গেছে বিষাদের নিস্তরঙ্গ স্রোত। এই উপন্যাসেও আনন্দের পাশাপাশি বেদনার চিত্র অঙ্কন করছেন লেখক অত্যন্ত কৌশলে। খিলগাঁওয়ের বাড়িওয়ালার ছেলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবিদের বন্ধু লুৎফর ছাগলনাইয়ার একটি অপারেশনে শহিদ হয়। আবিদ ফিরে আসে বীরদর্পে। এই উপন্যাসে আরেকটি বিষয় পাওয়া গেল, যা মহান মুক্তিযুদ্ধেও কোনো কোনো ব্যক্তির দুরাচার দুর্লক্ষ্যণীয় নয়। নরসিংদীর একটি অপারেশনের সময় ব্যাংক থেকে দশ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেল সবচেয়ে সিনসিয়ার মোশাররফ।
সর্বোপরি, এই উপন্যাসে দাদাবাঁধা কোনো গল্প নেই যে গল্প পাঠককে আটকে রাখতে পারে। আছে চরিত্রগুলোর মিথস্ক্রিয়া এবং তাদের কথোপকথনে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা, সংবাদ, বিশ^নেতাদের উক্তি। উপন্যাসে দানাবাঁধা গল্পও অনিবার্য নয়। সাহিত্য শব্দের ছবি। উপন্যাস একটি ক্যানভাস যেখানে কোনো পরিবারের, সমাজের, দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, পরিবেশত ও মনস্তাত্তি¡ক অবস্থার শব্দছবি চিত্রিত হয়। কিংবা উপন্যাস হয় ‘সোস্যাল ডিসকোর্সের’। রশীদ হায়দার স্বল্প পরিসরের এই উপন্যাসে দেশের ক্লান্তিলগ্নের দুঃসময়ের হায়েনাদের পীড়নের ও বর্বরতার শব্দছবি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে অঙ্কন করেছেন। এতে স্মৃতিমন্থনে ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হালচিত্র চিত্রিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বিভিন্ন দেশের বিরোধিতার চিত্রও উন্মোচিত হয়। এক পাঠান সৈনিকের নিজের মেয়ের প্রতি ভালোবাসার একটি আবেগঘন ঘটনা সন্নিবেশিত হয়েছে এই উপন্যাসে, যেটি পাঠকের মনে দাগ কাটে। বীভৎস লাশের দৃশ্যের বর্ণনা, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিবরণ পাওয়া যায় চরিত্রের মাধ্যমে। পরিশেষে, ভারতের স্বীকৃতি এবং জেনারেল স্যাম ম্যানেকশ ও জেনারেল নিয়াজির ভ‚মিকাও বর্ণিত হয়।
সবশেষে বিজয়-উল্লাসের গোলাগুলির আওয়াজ এবং প্রধান চরিত্রগুলোর ছাদে টিয়া পাখি উড়িয়ে স্বাধীনতাকে উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।
রশীদ হায়দারের ভাষা ঝরঝরে নিরেট চমৎকার। ছোট ছোট সরল বাক্যের প্রাধান্যই পুরো উপন্যাস জুড়ে। ক্লান্তিহীন পাঠে এক বৈঠকে শেষ করার মতো উপন্যাস।