দেশহীন লোকটির গল্প
ভাষান্তর : পারভেজ আহসান
আপনি জানতে চেয়েছেন কতোদিন যাবৎ আমি এখানে আছি । বার বছর হল । বছর গণনার কাজটি আমাকে বারবার করতে হয় । আমি প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণ বিষয়ক দপ্তর এবং অন্যান্য অফিসে নিয়মিত যাতায়ত করি । অভ্যন্তরীণ বিষয়ক দপ্তরে যাওয়া বলতে সেখান থেকে শুধু চিঠি পত্রাদি গ্রহণ করা । চিঠিগুলোতে করণীয় কাজ সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা থাকে । সেগুলো মানতে হবে । আপনার অসহযোগিতামূলক আচরণ তাদের মোটেও পছন্দ নয় । ঘুনাক্ষরেও কোনো ধরনের অমান্যতা চলবে না। প্রত্যেকে জানে চিঠির আড়ালে ব্যক্তির বিশেষ সুবিধা প্রত্যাহার , আটকাদেশ এবং নির্বাসনের মতো হুমকি লুকিয়ে থাকে ।
আমাকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্যে মনে হয় তারা উন্মুখ হয়ে আছে । ২০০৯ সাল থেকে নয় বছর যাবৎ তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কীভাবে আমাকে নির্বাসনে পাঠানো যায় । আমার এক বছরের জেল হয়েছিল । তার মানে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে নির্বাসনে যেতে হবে । অভ্যন্তরীণ বিষয়ক দপ্তর যাতে সহজেই নির্বাসনে পাঠাতে পারে সেই অভিপ্রায়ে আদালত কি আমাকে এক বছরের জেল দিয়েছিল? কিছু হৃদয়বান ভাল আইনজীবীর কারণে তারা সবসময় নির্বাসনে পাঠাতে সফল হয় না। যে দেশে আমাকে নির্বাসনে পাঠানো হবে সে দেশটি নিরাপদ না হলে অথবা আমাকে থাকার অনুমতি না দিলে তারা আমাকে পাঠাতে পরবে না । আমি পশ্চিম আফ্রিার একটি দেশ থেকে এসেছি। আমার জীবন বিপদাপন্ন হওয়ায় আমি সেখান থেকে পালিয়েছি । কিন্তু এখানকার কর্তৃপক্ষ বলছে এখন সে দেশ মোটেও বিপদজনক নয় । আমি নাকি নিরাপদেই সেখানে থাকতে পারব । কিন্তু আমি তা মনে করি না । সে দেশের নাগরিকত্বের কোন কোন কাগজপত্র নেই আমার হাতে নেই ।
রাষ্ট্র পরিচয়হীন হওয়ার জন্যে আমি আবেদন করেছি। রাষ্ট্রপরিচয়হীন হলেই আমি বসবাসের অধিকার পেতাম , কাজ করতে পারতাম , দেশের জন্যে অবদান রাখতে পারাম। একপর্যায়ে নাগারিকত্বের জন্যে আবেদন করতে পারতাম । কিন্তু সবকিছুই ধোঁয়াটে মনে হচ্ছে । আইন অনুযায়ী নিজেকে রাষ্ট্র পরিচয়হীন ব্যক্তি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ বিষয়ক দপ্তর নির্বাসনে পাঠানোর জন্যে ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্রাদি জোগাড়ের জন্যে দূতাবাসে পাঠাচ্ছে। আমি তিনবার দূতাবাসে গিয়েছি কিন্তু জাতীয়তার প্রমাণপত্র না থকায় তারা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। দূতাবাসে কর্মরত মহিলাটি আমাকে দেখে হেসেছিল। সে বলল, ‘ তুমি আবারো এসেছ? আমাদের কাছে পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ বিষয়ক দপ্তর তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। তুমি তো বহুবার এখানে এসেছ। কোনো লাভ হবে না। তুমি যে দেশ থেকে এসেছো সে দেশের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র লাগবে।’
কেন আমার কোন কাগজপত্র নেই? আমার অজ্ঞতা ও দুর্ভাগ্যের জন্যে আমি কেবল হাসি । হাসির ভেতর লুকাতে চাই দুঃখ। আমার জন্মভূমিতে খ্রিস্ট মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নারী হত্যার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো ও নারীদেরকে আলোকিত করার জন্যে জন্মান্ধ উগ্রাবাদীরা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সে সময়ে বার্নাড নামের এক ইংরেজ আমাকে আন্তারিকভাবে সাহয্য করেছিল। সে একটি ক্রিশ্চিয়ান এনজিওতে কাজ করত । আমার বিপদাপন্ন জীবনের কথা ভেবে সে আমাকে একটি চাকরি দিয়েছিল। আমি দেশ ত্যাগের জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম। আমার ইংরেজ বন্ধুর পরামর্শেই আমি এখানে এসেছি। আমার কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে সে ভিসা সীলসহ পাসপোর্ট ফেরত দেয়। ভিসা পাওয়ার মতো জটিল কাজ সম্পর্কে আমি তাকে বারবার জিজ্ঞাসা করলাম। আমি জানতে চাইলাম কীভাবে কাজটি সে দ্রুত সেরে ফেলল । সে আমাকে বলল, ‘এ বিষয়ে কিছুই জানতে চেয়ো না। সব কথা জানতে নেই।’ আমার আত্মীয়স্বজনরা যাতায়ত ভাড়া যোগাড়ে সাহায়তা করেছিল। আমি ও বার্নাড এক সাথে লন্ডন গিয়েছিলাম।
আমার জন্যে এতসব করায় আমি সত্যিই তার প্রতি কৃতজ্ঞ । আমি পূর্বে কখনো ইউরোপে আসিনি । আমাকে সাহায্য করার বিষয়ে তার আশ্বাস , আমার ভয় ও আতঙ্ককে দূর করেছিল অনেকটাই। এয়ারপোর্টের কর্মকর্তারা আমাকে অনেক প্রশ্ন করেছিল। তারা কেন প্রশ্ন করছে তা না বুঝেই আমি ভাল উত্তর দিয়েছিলাম। ভাল উত্তর না দিলে তারা দর্শনার্থী হিসেবে প্রবেশের অনুমতি দিত না। গেইট দিয়ে প্রবেশ করার সময় বার্নাড আমার পাসপোর্ট সম্পর্কে জানতে চাইল। সে বলল, ‘পাসপোর্ট আমার কাছে রেখে দেয়াই সবচেয়ে নিরাপদ।’ সে বলল আমাকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ক দপ্তরে গিয়ে শরণার্থী হিসেবে আবেদন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গেই আমি তাকে পাসপোর্টটি দিয়ে দিলাম। সে এক টুকরো কাগজে অভ্যন্তরীণ বিষয়ক দপ্তরের একটি ঠিকানা লিখে দিল এবং মুহূর্তের মধ্যেই সে উধাও হয়ে গেল। এরপর থেকে তার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি।
আমি জানি না আমি কেন তাকে পাসপোর্ট দিলাম। আমাকে বিপদে সাহায্য করায় আমি তাকে বিশ্বাস করে ছিলাম। আমি জানি না সে কেন আমার পাসপোর্টটি নিয়েছিল। হয়তো সৎ উদ্দেশ্যেই সে এ কাজটি করেছিল। সম্ভবত নিজেকে রক্ষা করতেই সে এমনটি করেছিল। আমার বন্ধুটি মানুষের ভিরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর আমারও মনে হয়ে ছিল তার সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না। অভ্যন্তরীণ বিষয়ক দপ্তরে যাওয়ার মত আমার কাছে টাকা ছিল না। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় ক্রয়েডনে অফিস বন্ধ ছিল। এমনকি সেই সময়ে জীবনের এক নতুন দীর্ঘ যাত্রা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। রাত কাটানোর জন্যে এক নিরাপত্তা কর্মী আমাকে একটি ঠিকানা দিয়েছিল। পরের দিন আমি ক্রয়েডনে অভ্যন্তরীণ বিষয়ক দপ্তরে গিয়ে সাক্ষাৎকার দেয়ায় সংশ্রিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাকে অস্থায়ী আবাস স্থলে পাঠিয়ে দিল। দপ্তরের কর্মকর্তারা যে আমাকে পছন্দ করে না তা বুঝতে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। আামি বুঝে ফেললাম আমাকে তাড়াতে পারলে তারা ভীষণ খুশি হবে। তারা বিশ্বাস করে না আমি যে দেশ থেকে পালিয়েছি সেই দেশে আমার জীবন খুবই বিপদাপন্ন। তারা আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করল। আমার হাতে কোন টাকা ছিল না। কেবলমাত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্যে একটি কার্ড ছিল। নিজেকে সুস্থ রাখতে , সামান্য কিছু উপার্জন করতে আমাকে কোন কাজ করাতে দেওয়া হত না।
কাজ খোঁজার কারণেই আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম। ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে কাজের জন্যে আমি নিবন্ধন করেছিলাম। আমার হাতে আমার জাতীয়তার কোনো প্রমাণপত্র ছিল না। সে কারণেই আমি ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করেছিলাম। একটি এজেন্সিতে কাজের নিবন্ধনের জন্যে গেলে এজেন্সি কর্মকর্তা সহজেই বুঝে ফেলে এই কাগজপত্র আমার নয়। লোকটি কাগজপত্রে স্বাক্ষর না করে আপত্তি করে বসল। সে আমার সম্পর্কে, আমার কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করল এবং আসল কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলল।
কয়েক মিনিটের মধ্যে দুটো গাড়ি ও চারজন পুলিশ চলে আসল। তারা আমাকে আটক করে ফেলল। পরের দিন আমাকে কোর্টে তোলা হল। কোর্টে আমাকে কোন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে সুযোগ দেওয়া হল না। কাজের জন্যে নিবন্ধন করার চেষ্টায় আমি অভিযুক্ত হইনি, বরং অবৈধভাবে চাকরির জন্যে অভিযুক্ত করা হলো আমাকে। কোনো প্রমাণ ছিল না, কোনো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছিল না, কোনো শুনানি ছিল না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চৌদ্দ মাসের জেল দেওয়া হলো। মুক্তির পর নির্বাসনে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হলো। আমি এ বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না। কয়েক মাসের মধ্যে আমাকে মুক্তি দেওয়া হল এবং স্ট্রাথাবেনে ডাঙ্গাভেল ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হলো। সেখান থেকে একটি ইমিগ্রেশন অপসারণ কেন্দ্রে নেওয়া হলো। কয়েক মাস পর আবারো স্ট্রাথাভেনে নিয়ে আসা হলো। দীর্ঘদিন যাবৎ আমি সেখানেই আছি। এখানে আমি তদারকির কাজ করি। প্রত্যেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে কী না তা তদারকি করি। এখানে কেউ হইচই করে না এই ক্যাম্পে ইরিত্রিয়ার দু’জন, আইভরি কোস্টের একজন এবং অন্য একজন হচ্ছে রাশিয়ান।
আমাকে গ্রেফতার করার পর কোর্ট খুব দ্রুত দণ্ডাদেশ প্রদান করল। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সংগ্রহ করার মতো কোনো সময় পাইনি। আমাকে গ্রেফতার করার পর আমার থাকার কক্ষটি খালি করা হলো। আমার স্ত্রী ও সন্তানের ছবি, আমার স্কুল সার্টিফিকেট, জন্ম সনদ এবং এড্রেস বুক ফেলে দেওয়া হলো। অভ্যন্তরীণ বিষয়ক দপ্তরের নির্দেশে ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্রাদি সংগ্রহ করার জন্যে দূতাবাসে গিয়ে নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণপত্র দেখাতে পারিনি।
এখানে আমি বার বছর ধরে আছি। এখনও আমাকে কাজের অনুমতি দেওয়া হয়নি । আমি গীর্জায় সহায়ক হিসেবে থাকি। সেচ্ছাসেবক হিসেবে হোস্টেলে বসবাসকারী মদ্যপদেরকে পরামর্শ দিই। এ কাজের জন্যে আমি আঠারো সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমি নিজে ভালো থাকার জন্যে সবকিছুই করি। কিন্তু মাঝে মাঝে ভীষণ ভেঙে পরি। আমার ছেলেমেয়েদের দুঃসংবাদ শুনলে বুকের পাঁজর ভাঙে মড়মড় শব্দে । এখন আমার বয়স উনষাট। সময় দ্রূত ফুরাচ্ছে। আমি ব্যাধি ও জরাগ্রস্ত । শরীরে অনেক ব্যধি বাসা বেঁধেছে। সারাক্ষণ মাথা ব্যথা ও উচ্চ রক্ত চাপে ভোগী। রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। ডাক্তার বলছে আমি বিষাদগ্রস্ত। আমি জানি বিষাদ কাটিয়ে ওঠার জন্যে ওষুধের প্রয়েজন নেই। আমি মুক্তি চাই। মুক্ত বাতাসের গন্ধ চাই।
আমি জানি রাষ্ট্র পরিচয়হীন মানুষ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করাই মুক্তির একমাত্র উপায়। কিন্তু বছরের পর বছর যাবৎ এ সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে জানি না। তবুও আমি আমার জন্মভূমিতে যেতে চাই না। সেখানে আমার জীবন বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে। আমি দেশহীন মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে চাই।
অভ্যন্তরীণ বিষয়ক দপ্তরের সকলেই খারাপ তা বলা যাবে না। এ দপ্তরে অনেক ভালো লোক আছে। অনেকেই আফ্রিকান শরণার্থীদের যন্ত্রণাকে দূর করতে চায়। তাদেরকে কাজ করার সুযোগ করে দিতে চায়। আচ্ছা আমি কী করেছি। তারা কেন এমন আচরণ করছে? এবার যদি তারা আমার আবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে আমি বাক্সপেটরা গুছিয়ে এই দপ্তরে গিয়ে বলব আমাকে অতলান্তিকে অথবা যেখানে ইচ্ছা সেখানে ফেলে দিন।