মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস আমার যত গ্লানি: রশীদ করীম
-মোজাম্মেল হক নিয়োগী
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মূলধারার লেখক হিসেবে রশীদ করীম একটি সুপরিচিত নাম। সন্দেহ থাকার কথা নয় যে, তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ও বিশিষ্ট সুসাহিত্যিক। তাঁর লেখার পরিমাণের দিক থেকে নয়, গুণগত নান্দনিক ও শিল্পমানের বিচার্যে তিনি সাহিত্যের উচ্চাসনে স্থান করে নিয়েছেন। সমকালীন জবীনবাস্তবতা, সমাজ ও মানুষের অন্তর্জগতের নিবিড় অনুসন্ধানের রেখাচিত্র তাঁর লেখায় পরিস্ফুটিত হয়েছে। তিনি ১২টি উপন্যাস লেখেন; তন্মধ্যে ৭টিই উত্তম পুরুষের ন্যারেশনে লেখা। এতে ধরে নেওয়া যায় তিনি উত্তম পুরুষে লেখায় বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘উত্তম পুরুষ’ সবচেয়ে বেশি পঠিত ও আলোচিত এবং ‘আমার যত গ্লানি’ মুক্তিকালীন লেখা, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হিসেবে সাহিত্যপ্রেমীদের কাছেও প্রিয় উপন্যাস হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
রশীদ করীমের সম্পূর্ণ নাম রশীদ করীম গোলাম মুরশেদ। কলকাতার ৩০ নম্বর ইউরোপিয়ান অ্যালাইলাম লেনে ১৪ আগস্ট ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। স্ত্রী সালিমা মুরশেদ (ডাকনাম ফুল), একমাত্র কন্যা নাবিলা মুরশেদ আমেরিকা প্রবাসী। রশীদ করীমের অগ্রজ আবু রুশ্দও একজন প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক। জানা যায়, তাঁদের পারিবারিক ভাষা ছিল উর্দু। তাঁর মা-খালারা ছিলেন মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্কুলের প্রথম চারজন ছাত্রী। তাঁর মাতামহ সৈয়দ আবদুল মালেক অ্যাডিশনাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন সদ্য বিধবা রোকেয়াকে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা দেন। তাঁর মাতৃকুল কতটা শিক্ষিত আধুনিক ও প্রগতিশীল ছিল তা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায়। অবশ্যই পিতৃকুলের খুব বেশি তথ্যাদি জানা সম্ভব হয়নি। প্রগতিশীল আধুনিক মায়ের দুসন্তান সুসাহিত্যিক হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন যা নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, বয়সের কারণে হোক কিংবা সামাজিক কারণেই হোক কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক না কেন দেশের কয়েকজন প্রথিতযশা কথাসাহিত্যেকের শেষ বয়সের নিঃসঙ্গ দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের মতো এই লেখকের জীবনেও নিঃসঙ্গতা ও দুর্দশা ছিল। ১৯৯২ সালের ২০ নভেম্বর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর থেকে ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত নিঃসঙ্গ থাকতেই পছন্দ করতেন। কারও সঙ্গে দেখা করতেও তাঁর প্রবল অনীহা ছিল।
রশীদ করীম ‘উত্তম পুরুষ’ উপন্যাস দিয়ে বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব স্থান করে নেন। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ১২। তন্মধ্যে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘আমার যত গ্লানি’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসটিও পাঠকসমাদৃত ও আলোচিত। ছোটগল্প ১টি, প্রবন্ধগ্রন্থ ৩টি, আত্মজীবনী ১টি।
আমার যত গ্লানি
১৮০ পৃষ্ঠার নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটি চমৎকার সাবলীল ভাষার নৈপুণ্যে উত্তম পুরুষে রচিত ‘আমার যত গ্লানি’। এই উপন্যাসকে মুক্তিযুদ্ধের বলা হলেও মূলত উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এরফানের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন ঘটনা এবং ব্যক্তি এরফানের সঙ্গে একাধিক নারীর পরকীয়া প্রেমিকাদের জীবনাচার ও যৌনাচার উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য। সময়ের ব্যাপ্তিতে উপন্যাসটি উনিশ শ একাত্তর সাল হওয়ায় কয়েকটি পার্শ্বচরিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেই সময়কার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কিছু ঘটনার উত্তাপ পাওয়া গেলেও প্রধান চরিত্রগুলোর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংস্রব অনুজ্জ্বল। স্মৃতিচারণের মাধ্যমে এরফানের শৈশব ও পশ্চিমবঙ্গে জীবনের ঘটনাবলি উপন্যাসে বিন্যস্ত হয়েছে। এই উপন্যাস একাত্তরের উত্তাল ঝঞ্ঝামুখর সময়ে স্বাধীনতাকামী জনবিস্ফোরণের ঘটনা প্রধান নিয়ামক হিসেবে নয়, প্রাসঙ্গিক উপাদান হিসেবে ধারণ করেছে। তবে উপন্যাসের শেষাংশে মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নের পাকহানাদারদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কয়েকটি খন্ড চিত্র এবং অকুতোভয় বাঙালিদের যুদ্ধের প্রস্তুতির ঘটনা বিধৃত হয়েছে।
এরফান মিয়া অভিজাত শ্রেণির মানুষ, কোনো এক কোম্পানির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এরফান মিয়া উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ও কথক। তার স্ত্রী ভেগে গেছে পূর্বের প্রেমিকের সঙ্গে। তারপর নিঃসঙ্গ জীবনে মদ আর কতিপয় নারীর সঙ্গে অবৈধ মেলামেশা করাই এই চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। বার আর ক্লাব তার দ্বিতীয় বাড়ি। মানুষের আদর্শিক বলয় ভেঙে নিজেকে নিকৃষ্ট মানুষের কাতারে দাঁড় করিয়ে কিছুটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস মিশ্রণে প্রধান চরিত্রের বয়ান পড়ে পাঠক কৌত‚হল-উদ্দীপনায় পাঠের যাত্রা শুরু করতে পারে। শুরুটা কৌত‚হল-উদ্দীপকই বটে। নির্মাণশৈলীর দিক থেকে লেখকের ‘উত্তম পুরুষ’ উপন্যাসের মতোই এই উপন্যাস। দুটি উপন্যাসেই পাঠককে যুক্ত করার উপন্যাসের পুরোনো ফরমেট; যা মীর মশাররফ হোসেন ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন; যেমন- “নিশ্চয়ই আপনাদের ভারি কৌতহল হচ্ছে, জানতে, ব্যাপার কি? স্ত্রী পালিয়ে গেল ঘটনাটা নিশ্চয়ই মজাদার। একটু শোনাই যাক।” [উপন্যাস সমগ্র, পৃ. ৩১৫]
কথাসাহিত্যিক রশীদ করীমের মোট বারোটি উপন্যাসের মধ্যে নয়টি উত্তম পুরুষে অর্থাৎ ফার্স্ট পারসনে লেখা। ‘উত্তম পুরুষ’ উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র নিজেকে যেভাবে উপস্থাপন করেছে যেমন- ‘আমি আদর্শ পুরুষ নই।’ একইভাবে ‘আমার যত গ্লানি’ উপন্যাসেও এরফান মিয়া নিজের সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেন।
‘‘আমি লোকটা আসলে একটা খচ্চর; যদিও, আমার বাপ লোকটা মোটের ওপর ভালোই ছিলেন। ভালো না বলে সজ্জন শব্দটিই ব্যবহার করতে পারতাম; কিন্তু কোথাও একটা বাধা পেলাম। তিনি যদি আর একটু অবস্থাপন্ন হতেন, তাহলে ঐ সম্ভ্রান্ত শব্দটিই ব্যবহার করা চলতো। [তদেব, পৃষ্ঠা ৩০১]’’
উপন্যাসটি শুরু হয় উনিশ শ একাত্তর সালে ঢাকা শহরে কোনো একটি ক্লাব থেকে, যে ক্লাবে প্লেবয় চরিত্রের এরফান মিয়া দুই বোতল বিয়ার পেটে চালান দিয়ে বের হওয়ার কথা ভাবছিল, ঠিক তখন প্রথমে নবী এবং পরে আয়েশা ভাবির সঙ্গে দেখা হয়। এই দুটি চরিত্র উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে কৌশলী লেখক তাদের স্বভাবের সঙ্গে সাজুয্য রাখতে ক্লাবে মদ্যপানের আসরে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। অতি আধুনিক বেপরোয়া আয়েশা ভাবি মূলত কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র, যার সঙ্গে এরফান মিয়ার গভীর প্রেমের সম্পর্ক, যাকে প্রচলিত সামাজিক নিয়মে পরকীয়া বলে। উপন্যাসের কাহিনি মূলত এই দুই চরিত্রকে কেন্দ্র করেই পরিণতি লাভ করে।
এই উপন্যাসের কাহিনি একমুখী নয়, একই দিকে গড়িয়ে নামেনি অথবা ওঠেনি। প্রধান চরিত্রগুলো একটি গল্পের বৃত্তে আবদ্ধ থাকেনি, কাহিনিও বৃত্তাবদ্ধ নয়। বন্ধুদের আড্ডাস্থলে যেমন নানামুখী আলোচনা হয়, ঠিক তেমনই এরফানের বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতায় নানামুখী বাতচিতে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, খেলাধুলা, সাহিত্য, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় উপন্যাসের ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে গেছে। উনিশ শ সত্তর সালে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন হয়েছিল, যা রাজনীতি-সচেতন মানুষের জানা। সে বছরের ১২ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরের উপক‚লীয় অ লে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘গোর্কি’র আঘাতে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল। এই ঘূর্ণিঝড়ের পরে অনেকে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন বাতিল করার জন্য টালবাহানা করেছিল, সে বিষয়টি ক্লাবে নবী বখ্শ ও এরফান মিয়ার মদ্যপান এবং এক নারীর শরীর নিয়ে জলো আলোচনা হয় এবং একই সময়ে একই আলোচনার অংশে স্থান পায় বিশ্ব ফুটবলের বিষয়ও।
এই উপন্যাসে বর্ণনা কিংবা মনস্তাত্তি¡ক কথনের চেয়ে দাপুটে প্রতাপ বিস্তার করে আছে সংলাপ। এই হিসাবে বলা যায়, এটিকে সংলাপ-শাসিত উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। তবে এই সংলাপ ‘একটি কালো মেয়ের কথা’ উপন্যাসের মতো এতটা বিস্তৃত ও প্রধান নয়, ন্যারেশনও রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। ভাষা আন্দোলন, জিন্নাহ, সোহরাওয়ার্দীর কথাও উপন্যাসে স্থান দেওয়া হয়েছে নবী ও এরফানের সংলাপে। একপর্যায়ে ক্রিকেট বল-কুড়ানি কিশোর আবেদ যে কিনা ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিল, এখন অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করে লন্ডনে থাকে, সেখান থেকে এরফান মিয়ার বাসায় এসে উঠেছে। একদিন বক্তৃতা করার জন্য আবেদ হোসেন নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় যায় বক্তৃতা করতে এবং এরফান মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যায়। কামুক এরফান মিয়াকে অবশ্যই কোনো নারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে নেওয়া হয় এবং সে রাতে গিয়ে ওঠে আবেদের আত্মীয় আহসানের বাড়িতে। আহসান এরফান মিয়ার অফিসে চাকরি করে। আহসানের স্ত্রী কোহিনূরের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। মদের আসরেই আবারও রাজনৈতিক আলোচনা স্খান পায়। ভাষা আন্দোলন, জিন্নাহ, গান্ধীজি, বঙ্গবন্ধু প্রমুখ নেতার নাম বিভিন্ন প্রসঙ্গে উঠে আসে। আক্কাস নামে কোনো এক কলেজের জনৈক লেকচারার উপস্থিত ছিল। আক্কাসের জিন্নাহপ্রীতি আবেদকে বিস্মিত করে। আবেদের দেশপ্রেম ও নেতৃত্ব চরিত্রগুলোর মধ্যে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা প্রকাশ করতে এক কিশোরকে একটি দৈনিকের সংবাদের আশ্রয় নিয়েছেন লেখক। আর তখনই এরফানের মধ্যে কিছুটা স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার টান প্রকাশও ঘটিয়েছেন।
একটি দশ-বারো বছরের ছেলে। গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছে। গরিব মা-বাপের ছেলে। কিছু না বলেই চলে এসেছে। বললে, অচেনা শহরে বা-মা আসতে দিতো না। না, বাক্স ভাঙেনি সে; একটি পয়সাও নেই তার পকেটে। হেঁটে এসেছে সারা পথ। দু’দিন কিছু খায়নি।
তার একমাত্র সাধ বঙ্গবন্ধুকে স্বচক্ষে দেখার। [তদেব, পৃ. ৩৫১]
এরফান মিয়ার সমগ্র সত্তা ডুবে আছে মদ আর নারীতে। উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ সময় এরফানকে ক্লাবেই দেখা যায়, সেভাবেই লেখক চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন। চরিত্র নারীর শরীরের ¯’‚ল বর্ণনা উৎকীর্ণ হয়েছে উপন্যাসের অনেক পাতায়; এমন একটির নমুনা
[…] তেমনি হাতের ওপর ভর দিয়ে এখনো গল্প করছে। সে কি তার ঐশ্ব্যর্য দেখাতে চায়? তাই যদি হয়, আমি প্রস্তুত।
দেখতে পাচ্ছি একতাল মাংস। নেকড়েকে পিঁজরার মধ্যে রাখা যাচ্ছে না। লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। হিংস্র ক্ষুধায় লম্বা নখ বসিয়ে দিতে চায়।
নিজেকে একটা ড্রাই-মার্টিনি দরকার। ওস্তাদরা বলেন অবশ্য, ডোন্ট মিকশ ইওর ড্রিঙ্কস। কিন্তু শাস্ত্রবাক্য ঢের শোনা আছে।
আমার মাথাটাও ককটেল বানাতে শুরু করে দিয়েছে। যে-মেয়েটির চোখ বন্ধ ডোবার পানির মতো, আর স্তন নেকড়ে বাঘের মতো, তার নাম কি হতে পারে? আর যে-মেয়ের চোখ নেকড়ের বাঘের মতো, তার স্তন বদ্ধ ডোবার পানির মতো-তার?
চিন্তাগুলো ছুটে আসছে চারদিক থেকে এক্সপ্রেস স্পিডে। আর দিয়াশলাইয়ের বাক্সের মতো চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে। একটির সঙ্গে আর একটির সংঘর্ষে। মনে হচ্ছে এইভাবে অনেক কিছুই চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। [তদেব, পৃ. ৩৬১]
এ-রকম কামোত্তেজিত অবস্থায় নিজেকে ঠান্ডা করতে এরফান স্মরণ করে গ্রিক মিথের কামাক্সক্ষী নারী হিপোলিটাসকে। এই উপন্যাস সৃষ্টিতে লেখক বিভিন্ন বিষয়েরই সমাবেশ ঘটিয়েছেন, মিথ, বিশ্বের ধ্রুপদী সাহিত্যের নামও কোথাও কোথাও জুড়ে দিয়েছেন। উপন্যাস জীবন ও সমাজের সামগ্রিক চিত্রের ক্যানভাস হিসেবে মিথ, সাহিত্য, সংস্কৃতির উপাদানও কখনো ঐশ্ব্যর্য হতে পারে, তবে অনিবার্য এমন কথা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। এরফানের মতো উ”চবিত্তে এমন পাঁড় মাতাল, নারী ও মদে মত্ত চরিত্রের অভাব নেই। এমন অনেক মানুষই তো আছে টাকা, নারী, মদ আর আনন্দেই কাটে তাদের সময়, দেশ নিয়ে ভাববার সময় তাদের নেই। এরফানের বাহ্যিক দিকে ভোগবিলাসের চিত্র দেখা গেলেও তার অন্তরে দহন কি নেই? কিছুটা হয়তো আছে। শৈশবে তার ছোট ভাই সাদেক পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল। সেই শৈশবের হর্ষবিষাদের স্মৃতি কখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। চৌদ্দ বছরের কিশোরের এরফানের গৃহকর্মী মেয়ে জৈবুনের সঙ্গে প্রেম, ইচ্ছাকৃত ¯œানের সময় জৈবুনের নগ্ন শরীর দেখানো এবং এরফান মিয়ার দেখা, মায়ের হারছড়া চুরি করে জৈবুনকে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শৈশব থেকেই এরফান মিয়া প্রেমিক-পুরুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছে।
জীবন কখনো একটি ধারায় প্রবাহিত হয় না। ‘অ্যাবসলিউট’ বলতে কিছু নেই। আয়েশা ও কোহিনূর এরফান মিয়ার প্রেমিকা। কোহিনূরের সঙ্গে আবেদের সম্পর্ক। আয়েশারও তাই। আবার দুজনের স্বামীই দেখেও না দেখার ভান করে এবং তারা জানে, এরফানের সঙ্গে দুজনেরই শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে। কোহিনূরের স্বামী আহসান চায় প্রমোশন। তাই স্ত্রীকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে এরফান মিয়ার কাছে। সামাদ হয়তো স্ত্রীর টান অনুভব করে না, তাই এরফানের অবাধ যাতায়াতে কখনো কোনো বাধা দেয়নি। বিদেশে লেখাপড়া করা আধুনিকা আয়েশার অন্তর্দহন আছে। কিš‘ সেই অন্তর্দহনের জন্যই কি নিজেকে এমন দেউলিয়া বানিয়ে পরপুরুষের জন্য সহজগম্য হয়ে গেল? নাকি নিতান্ত জৈবিক তাড়নায় বেসামাল? আয়েশা তরুণ বয়সে নানার বাড়িতে বেড়াতে এসে নানা ও সামাদ দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে এই সামাদই কৌশলে আয়েশাকে বিয়ে করে। তাদের দুজনের প্রেমে টালমাটাল সংসারÑ দেউলিয়া এরফান মিয়া। মাঝে মাঝে সময় কাটে আয়েশার বাড়িতে, পরকীয়ায় হাবুডুবু। আয়েশার স্বামী ও কন্যাসন্তান আছে। স্বামী নিরাসক্ত, রেপিস্ট যে কিনা আয়েশাকে বিয়ের আগেই রাতের গভীরে এক নৌকায় ধর্ষণ করেছিল। এরফান তারপর জড়িয়ে পড়ে তার অধীনস্থ কর্মকর্তার স্ত্রী কোহিনূরের সঙ্গে। বিছানায় যাওয়ার কোনো রগরগে বর্ণনা নেই, কিন্তু নারীশরীরের ¯’ূল রসাল বর্ণনা রয়েছে উপন্যাসে। মুখ্য চরিত্রটি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হলেও সক্রিয় নয়, নিরাসক্ত। এক রাতে আয়েশার কিশোরী কন্যাকে বাবুর্চি খালেকের সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখে এরফান মিয়া। কিশোরী কন্যাটিও মা-বাবার পথে হাঁটতে শুরু করেছে।
নিজের গ্লানির জন্য নিজেকে ধিক্কার দেয় এরফান মিয়া:
সত্যি, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি একটা শুয়োরের বাচ্চা । মাঝে মাঝে আবার একেবারে অন্যরকম হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। খানিকক্ষণ পারিও, অন্যরকম হয়ে থাকতে। আবার কি যে হয়, নিজের খসলতেই ফিরে আসি। ভয় কেবলি ভয়। রক্তকে আমার বড্ড ভয় হয়। আচ্ছা, এতো লোক, দুধের বাচ্চাও বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি পারি না কেন? ভয় কেবল আমারই। আমার মন যা চায়, আমার আচরণে, তার প্রকাশ থাকে না কেন? [তদেব, পৃ. ৪০৬]
আবার চলে আসে রাজনীতি, ৭ই মার্চের ভাষণের কথা, তবে জোরালো বা উত্তাল মার্চের কিংবা ৭ই মার্চের ঢাকার আবহ বাস্তবভিত্তিক ফুটে ওঠেনি। ৭ই মার্চের গনগনে রোদের দুপুর থেকে ঢাকার উত্তাল বাঁধভাঙা জনস্রোতের দৃশ্যায়ন নেই, নেই মিছিলে মিছিলে কম্প্রমান নগরের হালচিত্র। জগত কাঁপানো ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের জন্য উপন্যাসে আরেকটু স্পেস থাকতে পারত।
আবার আসে কোহিনূর, আয়েশা। আবার রাজনীতির ছিটেফোঁটা কথা। এরফান মিয়া চাকরিচ্যুত হয় আর তখন কোহিনূরও বাড়িছাড়া হয়ে যায়। রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পাওয়া যায় এরফানের মাঝে। তা থাকতেই পারে। কারণ, তখন অনেক মানুষের মধ্যেই যুদ্ধবিরোধী মনোভাব ছিল। মৌলবাদী গোষ্ঠী তো সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষেই অস্ত্র ধরেছিল। তবে বš‘নিষ্ঠতার বিচারে, পঁচিশে মার্চের রাতে গণহত্যার উল্লেখ রয়েছে, অনেক লাশ ঢাকার পথেপ্রান্তরে পড়ে আছে। সাতাশ মার্চে এরফান মিয়া ভাবছে আবেদ, আক্কাস, নবীন এরা কি বেঁচে আছে কি না!
মার্চের দু-একটা মিছিলের উত্তাপ সামান্য আছে। শেখ মুজিবের নাম দু-তিন জায়গায় উল্লেখ রয়েছে। উৎকীর্ণ হয়েছে, লোকজন স্বাধীনতার কাছে যায়, অর্থাৎ শেখ সাহেবের কাছে যায়। শেখ সাহেবকে স্বাধীনতার মহান নায়ক হিসেবে দেখানোর জন্য একটি বাক্যই যথেষ্ট। আবেদ, আক্কাস প্রমুখ চরিত্র স্বাধীনতার জন্য কাজ করে। মূলত কয়েকটি পার্শচরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের আবহ তৈরি করেছেন। কিন্তু‘ বোহিমিয়ান কামুক প্রকৃতির এরফান, মুখ্য চরিত্র, স্বাধীনতা কিংবা দেশের প্রতি নিস্পৃহ, যুদ্ধের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই, নেই কোনো সম্পর্ক। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে সারা দেশের স্বাধীনতাকামী অগ্নিমুখী মানুষেরা দুর্বার আন্দোলন মানুষকে শিহরিত করলেও সেই ধরনের আন্দোলন চিত্রিত হয়নি এই উপন্যাসে। বরং বলা যায়, আমোদ-ফুর্তি, মদ্যপান, নারীর শরীর নিয়ে খেলাধুলার বেশ উত্তম পরিবেশ ছিল; আরাম-আয়েশি জীবনযাপনের জন্য রাজনৈতিক পরিস্তিতি ছিল স্বাভাবিক। ফিকশন এমন হতে পারে, না হওয়ার কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া এ-রকম চরিত্রও না থাকার কথা নয়। কোথাও কোথাও চেতনাপ্রবাহে বর্ণিত হয়েছে পূর্বের কিছু ঘটনা।
পঁচিশে মার্চের রাতে অর্থাৎ ছাব্বিশে মার্চের প্রথম প্রহরের গণহত্যার সামান্য বর্ণনা রয়েছে। সাতাশই মার্চ এরফান লাশ দেখতে যায়। অগণিত লাশ। উপন্যাসের পরিণতি ঘটে।
সময়ের ব্যাপ্তিতে এই উপন্যাসের বর্ণনা ১৯৭১ সালের মার্চ মাস এবং ক্র্যাকডাউনের পাকিস্তানিদের নৃশংস ও পাশবিক হত্যাকান্ডের বর্ণনা উৎকীর্ণ হয়েছে এবং ২৭ তারিখে উপন্যাস শেষ হয়েছে। রশীদ করীমের ভাষা চমৎকার ও আকর্ষণীয়। উপমা, উপমেয়র ছড়াছড়ি, যা উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেছে। হ্রস্ব ও নাতিদীর্ঘ বাক্যে বয়ান। অভিজাত ও উচ্চশিক্ষিত এরফানের চরিত্র চিত্রিত করার জন্যেই হয়তো লেখক বেশ কিছু বিশ্ব ক্ল্যাসিক উপন্যাসের নাম উল্লেখ করেছেন। কিছু সংশ্লিষ্টতা আছে, কিছু নেই প্রায় দুই শ পৃষ্ঠার ‘আমার যত গ্লানি’ উপন্যাসটিতে।
মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের যখন অনুসন্ধান করেছিলাম, তখন এই উপন্যাসেরও নাম বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হিসেবে আমাদের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এটিকে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস কেন বলা হয় বা বলা হবে, তার কোনো জোরালো যুক্তি আমরা খুঁজে পাই না। একাত্তর সালের সময়কে ধারণ করে কোনো উপন্যাস লিখলেই কি সেটা মুক্তিযুদ্ধের হবে কি না, এই বিষয়ে সংশয় রয়ে গেল। এই প্রশ্নের মীমাংসা হওয়াও প্রয়োজন। পঁচিশে মার্চের গণহত্যার হালকা বর্ণনা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের কিংবা স্বাধীনতার জোরালো কোনো বক্তব্য বা বর্ণনা নেই। প্রধান চরিত্রগুলো তো দূরের কথা, পার্শচরিত্র আক্কাস ছাড়া আর কোনো চরিত্রের মাধ্যমেও স্বাধীনতার কথা, যুদ্ধের কথা জোরালোভাবে কোথাও উচ্চারিত হয়নি। যদিও ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর অনেকেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তথাপি ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা বলার সুযোগ কি আদো আছে? তবে প্রধানচরিত্রগুলোর যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে কিংবা পরবর্তী কোনো ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা থাকা প্রয়োজন ছিল বলে প্রতীয়মান হয়? পঁচিশে মার্চের রাতে কোনো চরিত্রের অংশগ্রহণ নেই কিংবা গণহত্যার শিকার হয়েছিল কি না তারও পরিষ্কার বর্ণনা এই উপন্যাসে নেই। তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, এটি ফিকশন হিসেবে উ”চমানের, রাজনৈতিক সচেতনতায় সামাজিক উপন্যাস হিসেবে প্রশংসার্হ।