বাংলাদেশে উত্তরবঙ্গের মাটি ও মানুষের জীবনঘেঁষা সাহিত্য সৃষ্টিতে শওকত আলীকে বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়। তাঁর অগ্রজ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় খ্যাতিমান সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর কল্পিতভ‚মি জলেশ্বরীকে আশ্রয় করে অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন; যে সাহিত্যে উত্তরবঙ্গের জনজীবনই চিত্রিত হয়েছে। মঞ্জু সরকার, শওকত আলীর অনুজ কথাসাহিত্যিকও উত্তরবঙ্গের জনপদের কথা সফলভাবে চিত্রিত করেছেন।
তিনি অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. খোরশেদ আলী সরকার এবং মা সালেমা খাতুন। শওকত আলী ছিলেন তাঁদের তৃতীয় সন্তান। তাঁর ছোট ভাই বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পী আবদুর রোউফ সরকার।
তিনি কলকাতার মিশনারি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির মাধ্যমে লেখাপড়া শুরু করেন। কিš‘ ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে কলকাতায় আক্রমণ শুরু হলে তারা সপরিবারে রায়গঞ্জে ফিরে আসেন। রায়গঞ্জে তাঁর মা সেখানকার বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন এবং বাবা ডাক্তারি পেশা শুরু করেন। সেখানে তিনি করোনেশন ইংলিশ হাইস্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন; ১৯৫১ তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর ১৯৫২ সালে শওকত আলী তাঁর ভাইবোন নিয়ে পূর্ব বাংলার দিনাজপুরে স্থানান্তরিত হন। পরবর্তীকালে ১৯৫৩ সালে তাঁর বাবাও চলে আসেন।
তিনি ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আইএ পাস করেন। কলেজ জীবনে কমিউনিস্ট দলের জড়িয়ে যান। ১৯৫৪ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৫ সালে তিনি বিএ পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম.এ ভর্তি হয়ে ১৯৫৮ সালে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৫ সাল থেকেই তাঁর লেখা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। তিনি প্রথমে হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পরে ঠাকুরগাঁও কলেজে, তারপর জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যাল)। ১৯৮৮ সালে তিনি জেলা গেজেটিয়ারের ঢাকার হেড অফিসে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করে পরিচালক পদে উন্নীত হন। ১৯৮৯ সালে সরকারি সংগীত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ৩২টি উপন্যাস, ৬টি গল্পগ্রন্থ রচনা করেন। বাংলা একাডেমি ও একুশে পদক অর্জন করেন তিনি।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে শওকত আলীর স্থান অনেক উঁচুতে। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসের তাঁর কথাসাহিত্যের শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। একটিমাত্র উপন্যাস তাঁকে সাহিত্যের ইতিহাস অম্লান করে রাখবে। আর কোনো উপন্যাস না লিখলেও চলতো। শওকত ওসমানকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ই যথেষ্ট। কিন্তু এরপরও তাঁর যেসব উপন্যাস সাহিত্যপিয়াসিদের তৃষ্ণা মিটিয়েছে সেগুলো হলো: দক্ষিণায়নের দিন (ট্রিলজি: দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্ব দিন), উত্তরের খেপ, নাঢ়াই, পিঙ্গল আকাশ, অপেক্ষা, গন্তব্যে অতঃপর, অবশেষে প্রপাত, জননী ও জাতিকা, জোড় বিজোড় ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তাঁর উপন্যাসগুলো: যাত্রা, হিসাব নিকাশ, স্ববাসে প্রবাসে, অপেক্ষা ও ঘরবাড়ি।
যাত্রা
আটটি অধ্যায়ের বিন্যাসে প্রায় ৮০ পৃষ্ঠার নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটি তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধের পাঁচটি উপন্যাসের মধ্যে প্রথম, প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। কাহিনির তেমন ডালপালা নেই; আকর্ষণীয় কোনো গল্প নেই, পঁচিশে মার্চের পাক হানাদারদের আক্রমণের পরদিন ভোরে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষের একটি স্থানে সমবেত হওয়ার গল্প, তাদের মিথস্ক্রিয়া, আশা-নিরাশার কথোপকথন। পাকিস্তানি মিলিটারি পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা চালানোর প্রাক্কালে জীবন বাঁচানোর জন্য অসংখ্য মানুষ উদ্দেশ্যহীনভাবে প্রথমে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়। নদী পার হওয়ার সময় ভীতসন্ত্রস্ত শেকড়ছেঁড়া জনগোষ্ঠীর যে-রকম পরিচিতি ও মনোভাব থাকে, সে-রকম পরিচিতির নিটোল বর্ণনা করেছেন লেখক শওকত আলী। এই বর্ণনায় প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর তীক্ষ অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞার। যেন কিছুই বাদ যায়নি। দৃশ্যকল্প ও চরিত্রগুলো ইমেজের মতো পাঠকের চোখে দৃশ্যমান হয়। পালিয়ে যাওয়ার পথেও ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলোর মধ্যে তিনি হাস্যরসও সৃষ্টি করেছেন, যা বাস্তবানুগ। যাত্রীদের মধ্যে অনেক চরিত্র ক্রমে ডালিমদানার মতো বের হতে থাকে। উপন্যাসের শুরুটা লক্ষ করা যাক।
হুড়োহুড়ি পাড়াপাড়ি করে নৌকোয় ওঠান আস্তে আস্তে, ভিড় কইরো না, আর উইঠেন না—নাও ডুববো কইলাম। কিন্তু কেউ কারো কথা শোনে না। এই মাঝি, এদিকে, আনো—ধমকে উঠল কেউ। ওদিকে আরেকা নৌকা আসছে, ওদিকে যান না। ভাই ধীরে সুস্থে কাজ করুন। নৌকোটা ডুবো ডুবো অবস্থায় ছাড়ল। প্রফেসরের স্ত্রী চশমা চোখে, দুচোখে কালি পড়েছে নির্ঘুম রাতের। বাচ্চা দুটি কখনো নৌকোয় চাপেনি, নৌকোয় দুলুনিতে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠলো। বাচ্চা দুটি চিৎকার করতে শুরু করলো, রাখাইল্যা রইয়া গেলো, নাও ঘুরাও, বাবারা নাওডারে ঘুরাইতে কও, আমার রাখাইল্যা রইয়া গেলো। বুড়ির কথা শুনে না কেউ। প্রফেসরের বাচ্চা দুটি কাঁদছে ভয় পেয়ে, তাদের কথাও শোনে না কেউ। পায়ের ব্যথাটা ভয়ানক টনটন করছে এখন। [মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র, পৃ. ১১]
এভাবে নৌকা চলছে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিতে। বুড়ির সংলাপটি কতটা জীবন্ত, একবার অনুমান করা যেতে পারে। শওকত আলীর শিকড় যে গ্রামের মাটিতে প্রোথিত, তা এই সংলাপের মাধ্যমে সহজেই অনুমেয়। ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে গ্রামের দিকে যাওয়ার মানুষের সঙ্গে দু-একটি মুরগিও রয়েছে, সে বর্ণনাও এখানে পাওয়া যায়। এই চিত্রকল্পগুলো উপন্যাসে প্রাণ সঞ্চার করেছে। পূর্ণগর্ভা ছাগল সঙ্গে নিয়ে যাওয়া, বাক্সপেটরার বর্ণনা, নদীতে নামার বর্ণনা, মুরগির হাতের উপর ডিম পাড়ার বর্ণনা একদিকে হাস্যরসের সঞ্চার করে, অন্যদিকে মানুষের বিচিত্র জীবনের ডিটেইলিং উপন্যাসটিকেও শিল্পসুষমায় সমৃদ্ধ করেছে।
প্রথম প্যারাতেই প্রফেসর ও তাঁর পরিবার এবং পায়ের ব্যথাধারী একটি চরিত্রের উল্লেখ রয়েছে, যে চরিত্রটি মূলত গণহত্যার রাতে পায়ে গুলি লাগা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের, নাম হাসান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ প্রফেসরের নাম রায়হান। ছোট্ট কলেবরের এবং এক সপ্তাহ সময়ের ব্যাপ্তিতে এই উপন্যাসে প্রধান চরিত্রও মূলত রায়হান ও হাসান। প্রথাগত নিয়মে উপন্যাসের নায়ক বলতে যা বোঝায় তা হলো আহত হাসান এবং তার সহপাঠিনী লীলা কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র। কিন্তু হাসান চুপচাপ স্বভাবের হওয়ায় ক্লাসে তার সঙ্গে লীলা বা স্মার্ট ছেলেমেয়েদের সখ্য গড়ে ওঠেনি। এখানে লীলা হাসানকে আবিষ্কার করে, তার দুরাবস্থায় পাশে দাঁড়ায়। ভাবাবেগ সঞ্চারিত উভয়ের মনোভ‚মিতে।
নদীর ওপারে প্রফেসর রায়হানের ছাত্র আসগরকে পাওয়া গেল। আসগররা স্থানীয় তরুণদের নিয়ে আশ্রয়হীন দুর্দশাগ্রস্ত পালিয়ে আসা মানুষদের আশ্রয় দেওয়াসহ সার্বিকভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করছে। তারা কয়েকটি শটগান, গোটা তিনেক ৩০৩ রাইফেল, বাঁশের লাঠি নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য তৈরি হয়েছে। গুলিতে আহত হাসানের পায়ের অবস্থঅ যেমন তেমন একটি হাত প্রায় অচল হয়ে গেছে। ওদের এই প্রস্তুতি নিয়ে আসগর যখন বলল, স্যার চিন্তা করবেন না। তখন হাসান হাসে। এইসব সম্বলই তখন বাঙালির সাহসের উৎস ছিল। স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রাখলে কামানের সামনে বুক চিতিয়ে দিতে বীরেরা কুণ্ঠাবোধ করে না, মৃত্যুকে বরণ করার জন্যে তখন এমন অকুতোভয় বীরের এ দেশে অভাব ছিল না।
নদী পার হওয়ার পর একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী কোনো এক গ্রামের স্কুলে আশ্রয় নেয়। সেখানে আরও অনেকগুলো চরিত্র পৃষ্ঠাজুড়ে বনফুলের মতো ফুটতে থাকে। বিচিত্র সব চরিত্র। ফুর্তিবাজ যোসেফ ফার্নান্দেজ চরিত্রটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি প্রৌঢ় খ্রিষ্টান হওয়ায় মৃত্যুর আশঙ্কা কম মনে করেন। মুক্তিযুদ্ধে খ্রিষ্টানরা অনেকাংশেই নিরাপদ ছিল; কিন্তু হিন্দুদের ওপর ছিল সবচেয়ে বেশি ঝড়ঝাপটা। তারাই বেশি নির্যাতিত হয়েছে পাকিস্তানি মিলিটারি, বিহারি এবং এদেশীয় রাজাকার, আলবদরদের দ্বারা। যোসেফ ফার্ন্দান্দেজের বাড়ির সামনেই হিন্দু নীলরতন ভট্টাচার্যকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সে বর্ণনা তার মুখে পাওয়া যায়।
ছোটখাটো অনেক বর্ণনা এই উপন্যাসের বাস্তবতার দ্যোতনা। লেখকের চিন্তা ও দৃশ্যকল্প তৈরিতে উচ্চমাত্রার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মনে হয় যেন তিনি মানুষগুলোর মনের পৃষ্ঠাগুলো খুলে পড়ছেন এবং তাদের মনোভাব উপন্যাসের ক্যানভাসে চিত্রিত করছেন। এমন দৃশ্যকল্প দেখা যায়, নৌকো থেকে নামার দৃশ্যাবলি, তরুণীর মুখে পাউডারের প্রলেপ, সাকিনার পাশের খেতে নেমে টমেটো খাওয়া ইত্যাদি অনেক ছোট ছোট দৃশ্যের ব্যঞ্জনা উপন্যাসের কাহিনিকে বিশ্বস্ত ও বাস্তব করে তুলেছে। বর্ণনা-শাসিত উপন্যাসে স্থানীয় কয়েক যুব শিকান্দার, আসগর, সাকেরসহ আরও অনেকের সহযোগিতায় আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার তৎপরতার তখনকার যুবদের বাস্তব প্রতিচিত্র। ইতিহাস-সচেতন এবং যারা একাত্তর সাল দেখেছে, তাদের চোখে এই দৃশ্য অতি পরিচিত, নিরেট বাস্তব। আশ্রিত মানুষগুলোর মধ্যে নানান পেশার লোক রয়েছে, শিক্ষাদীক্ষা ও সামাজিক মর্যাদায়ও ভিন্নতা রয়েছে। তাঁদের রাজনীতির হালকাপাতলা বিশ্লেষণ আখ্যানের গতি ও কলেবর বৃদ্ধি করেছে। এর মধ্যে গুজব ছড়ায়, যা সাধারণত যুদ্ধের সময় হয়ে থাকে।
আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষগুলো কোথায় যাবে? দেশের নানা এলাকায় তারা যাবে। কিন্তু যাওয়ার উপায় কী? এখানে থেকে তারা যাওয়ার পথ খুঁজছে। ওরা ঢাকা পার হয়ে রোহিতপুরের কাছাকাছি কোনো এলাকায় রয়েছে। সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর যোসেফ ও রায়হান ঢাকায় আসতে চাচ্ছে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার জন্য। ওরা ক্লান্ত, অবসন্ন, তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত; কয়েকজন অসুস্থ। এই অবস্থায় আশ্রয়কেন্দ্রের পরিবেশ হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কেউ লঞ্চে নদী পাড়ি দিতে চাইলেও সেই সুযোগ হয়েও যেন হয় না। এমন একটি সংকট দেখা দেয় তেলের ক্ষেত্রে :
ধলেশ্বরীর ওপার, নদী পার হয়ে আরেক নদী। ঘাটের কাছেই একটি ঝাঁকড়া আমগাছ বোধ হয়। সৈয়দপুর ঘাটে কস্মিনকালেও এতো লোক জড়ো হয়নি। ঘাটে একখানা লঞ্চ, লঞ্চের গায়ে লেখা এস এস জলপরী। মানুষ ভর্তি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু লঞ্চ ছাড়বে কিনা ঠিক নেই। ইঞ্জিনে তেল নেই, তেলের জোগাড়ে গেছে সারেং-যদি পায়, তাহলে ছাড়বে, যদি না পায়, তাহলে ঐভাবেই নোঙরে বাঁধা থাকবে লঞ্চ। সারেং আর লঞ্চে ফিরবে না। [তদেব, পৃ. ৩৩]
হাসানের শারীরিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। তার গলা শুকিয়ে যায়, পিপাসায় কাতরায়, রক্তক্ষরণ তো আছেই। এই সময় বিনু ভাবি মাতৃত্বের মমতায় তার মুখে পানি তুলে দেয়। তারপর এগিয়ে আসে লীলা। সে-ও নির্বিঘ্নে হাসানের কপালে হাত রেখে আঁতকে ওঠে। রায়হানের দুই শিশুসন্তান জ্বরে আক্রান্ত। ওদের মা বিনুর অস্তিরতা ও হতাশার শেষ নেই সন্তানদের জন্য। হাসানের গায়ে জ্বর ক্রমাগত বাড়ছে। লীলা তখন হাসানের সান্নিধ্যে চলে আসে। ওদের মিথস্ক্রিয়া ও রসায়নে ভালো লাগার উত্তাপ ছড়ায়। এই ভালো লাগার উত্তাপ থেকে প্রেমের আভাস ফুটে উঠতে থাকে। কিন্তু হাসান কি বুঝতে পারে অথবা বোঝাতে পারে ওর অনুভূতি? সে ক্রমান্বয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। লেখকের বর্ণনায়:
হাসান কিছু শোনে, কিছু শুনতে পায় না। কিন্তু স্বপ্নের দৈববাণীর মতো চেতনায় এসে যায় লীলার কথা। চোখ মেললে কখনও লীলার মুখ দেখতে পায়, কখনো দেখতে লীলার অবয়ব ভেঙে ভেঙে গলে গলে যাচ্ছে। হাসান একহাতে চোখ ঘষে ঘষে দেখে লীলাকে। ভাবে কিছু বলবে, কিন্তু বলা হয় না। দারুণ নিঃস্ব আর ক্লান্ত লাগে নিজেকে। [তদেব, পৃ. ৪৩]
যাত্রা উপন্যাসের আরেকটি আকর্ষণীয় ও রসাত্মক ঘটনা হলো শাকেরের ভাবাবেগ। শাকেরের ভাই রায়হান স্যারের ছাত্র ছিল এবং বর্তমানে বিলেতে থাকে। অবস্থা সম্পন্ন শিক্ষিত মানুষ শাকের লীলার প্রেমে পড়ে যায় এবং আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে তাদের বাড়ি হওয়ায় তাকে বাড়িতে দাওয়াত দেয়। বিনয়ী ও ভদ্র শাকের মাকেও জানিয়েছে লীলার কথা। শাকেরের এই ভাবাবেগকে লীলা বোকামি মনে করে হাসে। এই ঘটনাও ফিকশনটিকে জোরালো করেছে। শাকের তরুণ আইনজীবী, তার বড় ভাই লন্ডনে লেখাপড়া করে, যিনি প্রফেসর রায়হানের ছাত্র সেই সুবাদে লীলার জন্য নিজেকে উপযুক্ত পাত্র ভাবতেই পারে। তার মাকে দেখানোর জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের পাশের গ্রামে যাওয়ার জন্য দাওয়াত দিল।
আশ্রয়কেন্দ্রটিও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে, নদীতে গানবোট নেমে গেছে। পাকসেনারাও গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। এই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন সরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। হাসানের এখান থেকে যাওয়ার উপায় নেই। সে নড়তে-চড়তেই পারে না। লীলাকে সে তাগিদ দিচ্ছে যেন অন্যদের সঙ্গে সে-ও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। কিন্তু লীলা যায়নি। ক্ষুদ্ধ হাসান লীলার সরে যাওয়ার জন্য অস্তির হয়ে পড়ে ভর্ৎসনা করলেও লীলা যায়নি।
অন্ধকারে হাসানের হাত ধরলো লীলা। হাসানের হাতে কালরাতের সেই রাইফেলটা, রাইফেলের গা ঠান্ডা-নলটা জানালার ওপর রাখা, হাসান উপুড় হয়ে বিচিত্র ভঙ্গীতে শুয়ে আছে। সম্ভবত জানালা দিয়ে বাইরে নজর রাখছে।
চলো, এখান থেকে সরে যেতে হবে।
হাসানকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে তুলতে চেষ্টা করলো লীলা। মুখে বললো, আর এক মুহূর্ত এখানে নয়। [তদেব, পৃ. ৮৭]
দূরে কোথাও গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। ওদের উৎকণ্ঠা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু লীলা কি হাসানকে ছেড়ে চলে যাবে? তারা যায়নি। ঔপন্যাসিক শওকত আলী স্বাধীনতার সূর্যালোকের আশার বাণী ছড়িয়েই উপন্যাস শেষ করেছেন। হয়তো ট্র্যাজেডিও তৈরি করতে পারতেন, কিন্তু তা করেননি। স্বাধীনতার সুখের ও আনন্দের বার্তা দিয়েই তিনি উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। তিনি উপন্যাসটি শেষ করেন:
শেষে দুজন পাশাপাশি বসে। হাসান একবার বলে, নদী পার হয়ে ওরা আজ এপারে নাও আসতে পারে। বলে কথা-নিঃসন্দেহ হতে পারে না। সে জানে, কিছুই তো বলা যায় না শত্রুর সম্পর্কে। দুজনে তাই অপেক্ষা করে থাকে। জখম শরীর, এক হাতে রাইফেল-জানালা দিয়ে দেখতে পায়, নদীর ওপারে, দিগন্তরেখার কাছে তখনও তুমুল গুলি হচ্ছে গ্রাম জ্বলছে, খামার বাড়ি জ্বলে যাচ্ছে। দুজনেই দেখতে পায়, লেলিহান শিখা, ধোঁয়ার কুন্ডলী এবং আর্তচিৎকারময় আকাশে ওপারে নিয়ে ভারী বিবর্ণ সূর্যোদয় হচ্ছে। [তদেব, পৃ. ৯০]
এই উপন্যাসের নির্মিতি পাঠককে ভাবাতে পারে। কারণ, দুটি নদী পার হওয়ার মধ্য দিয়ে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে মাত্র ছয় দিনের অবস্থানের মধ্যে একটি উপন্যাস সৃষ্টি হতে পারে, যা কাহিনির চেয়ে নির্মিতিতে লেখকের প্রজ্ঞা ও শিল্পশৈলীর পরিচয় মেলে। লীলা ও হাসান একই ক্লাসে পড়লেও তখন তাদের মধ্যে কোনো ভাবাবেগ সৃষ্টি না হলেও হাসানের দুর্দশার সময় লীলা সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে মহত্বের পরিচয় দেয়। একদিকে হাসান হয়ে উঠেছে দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী যুবক এবং হাসানের দুঃসময়ে মৃত্যুর কাছাকাছি থেকেও, বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও এক বীরে পাশে থেকে লীলাও হয়ে উঠেছে বিপ্লবী ও মহীয়সী নারী। যেন যুদ্ধক্ষেত্রে হয়তো প্রেমিকা সেবিকা অথবা সহযোদ্ধা, দেশপ্রেমের উজ্জ্বল শিখা।