শিকড়সন্ধানী ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসের পাঠককে ঘোরে আ”ছন্ন করে রাখার ক্ষুরধার লেখনীর লেখক রিজিয়া রহমানের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের ভবানীপুরে, ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। মেদহীন ভাষায় রচিত তাঁর কথাসাহিত্য বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ। তাঁর উপন্যাসগুলো ছোট কলেবরের হলেও দীর্ঘ সময়ের স্রোতকে স্বল্প আঁচড়ে ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে তিনি সন্দেহাতীতভাবে একজন প্রাজ্ঞ ও দক্ষ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। ‘বং থেকে বাংলা’ আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস ২৯৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থে সন্নিবেশ করে অনন্য শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। এই মহীয়সী বিদগ্ধ নারীর শৈশবও কিন্তু সহজ ছিল না, যাপিত জীবন ছিল না কণ্টকমুক্ত। অনেক বাধা অতিক্রম করে তিনি স্বীয় মেধা ও অক্লান্ত শ্রম দিয়ে নির্মাণ করেছেন সাহিত্যিক ক্যারিয়ার, বড় মাপের কথাশিল্পীর আইডেনটিটি। রিজিয়া রহমানের জীবনের শুরু ছিল কলকাতায়। তাঁর বাবা পেশায় ডাক্তার ছিলেন। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁকেও বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। ফলে বিভিন্ন স্থানের লোকাচার ও মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলে শৈশব থেকেই তিনি লেখার রসদ পেয়ে আসছিলেন, যা পরবর্তী জীবনে তাঁর লেখাকে সমৃদ্ধ করেছে। তেরো বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৫২ সালে তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁরা নানা রকম সংকটের ঘূর্ণাবর্তে পড়েন। ফরিদপুরে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও সেখানে লেখাপড়া শেষ হয়নি। তাঁর মামা চাকরি করতেন চাঁদপুরে। রিজিয়া রহমানকে তখন চাঁদপুরের একটি মাধ্যমিক স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। মামার পরিবার রক্ষণশীল হওয়ায় তাঁর স্কুল বন্ধ হয়ে যায় এবং পরে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। সাংস্কৃতিক আবহে গড়ে ওঠা রিজিয়া রহমানের বাবা সংগীত অনুরাগী, তিনি এসরাজ ও বাঁশি বাজাতেন, শুনতেন উ”চাঙ্গসংগীত। বাবার মৃত্যুর পর তাঁকে চিন্তা ও বাস্তব জীবনের দ্বা›িদ্বকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বাবার পরিবার ছিলেন যেখানে সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র আর মামার পরিবার রক্ষণশীল হওয়ার কারণেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এমন বৈপরীত্যের মধ্যেও প্রগতিশীল চিন্তা ও কর্ম থেকে থেমে থাকেননি। দৃঢ় মানসিকতা ও সাহসিকতার সঙ্গে তিনি প্রতিক‚ল পরিবেশে থেকেও সাহিত্যচর্চায় গভীরভাবে মনোযোগী হন।
লেখালেখির শুরুটা বাংলাদেশের অধিকাংশ লেখকের মতো তাঁরও কবিতা দিয়ে; যদিও পরবর্তী সময় দুটি ছড়াগ্রন্থ ছাড়া কবিতার কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় ছোটদের পাতায় তাঁর প্রথম গল্প টারজান ছাপা হয়। খেয়ালে খেয়ালে কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও তিনি শেষাবধি কথাসাহিত্যে, বিশেষ করে উপন্যাসে নিমগ্ন হন। ‘অগ্নি-স্বাক্ষরা’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ। এরপর আরও চারটি গল্পগ্রš’ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম উপন্যাস ‘ঘর ভাঙা ঘর’; যেটি লেখা হয় ১৯৬৭-১৯৬৮ সালে, ছাপা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। উপন্যাসের ধারায় রিজিয়া রহমান নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করেন। তাঁর উপন্যাসগুলোর অধিকাংশই ঐতিহাসিক, অন্ত্যজ ও দলিত জনগোষ্ঠীর জীবনধারার প্রেক্ষাপটে রচিত। যদিও প্রেমের উপন্যাস তিনি কম লেখেননি—৯টি; কিন্তু সেসব উপন্যাস সেভাবে আলোচিত হয়নি। সামাজিক ও রাজনৈতিক উপন্যাসের সংখ্যা ৫। তিনি শিশুতোষ তিনটি বই লিখেছেন। তন্মধ্যে দুটি ছড়ার বই। এ ছাড়া রয়েছে অনুবাদ ও রম্য গল্প সংকলন একটি করে মোট দুটি। অবহেলিত মানুষের ওপর ভোগবাদী, পুঁজিবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মোড়লদের নির্যাতন, নিপীড়ন, নিষ্পেষণ, নারীর অমর্যাদাকর দীনতা, পতিতাবৃত্তির করুণ আর্তস্বর ইত্যাদি বিষয় এই লেখকের সাহিত্যকর্মকে অন্যান্য লেখকের লেখা থেকে স্বাতন্ত্র্য জগৎ সৃষ্টি করেছে। তাঁর প্রতিটি উপন্যাস পাঠেই পাঠকের মনে হবে যে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এবং তিনি প্রচুর হোমওয়ার্ক করে উপন্যাস নির্মাণ করেছেন; যা খ্যাতিমান সব কথাসাহিত্যিকের কাজেই পরিলক্ষিত হয়। জলো আবেগে গা ভাসিয়ে এক বসায় উপন্যাস নির্মাণের লেখক রিজিয়া রহমান নন। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তা সম্পূর্ণই শ্রম ও মেধা খরচ করে।
রিজিয়া রহমান মোট তেত্রিশটি উপন্যাস লিখেছেন, যেগুলো বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হলেও সম্প্রতি ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে ছয় খন্ডের সব কটি প্রকাশিত হয়েছে। লেখক জীবদ্দশাতেই তাঁর উপন্যাসের শ্রেণিবিন্যাস করে গেছেন। ফলে পাঠক, গবেষক বা সমালোচকদের জন্য খুব বেশি সময় খরচ করে শ্রেণিবিন্যাস করতে হয় না। তিনি যেভাবে শ্রেণিবিন্যাস করেছেন তা হলো: ঐতিহাসিক (অলিখিত উপন্যাস, আঁবে রওয়া, আলবুর্জের বাজ), নৃতাত্বিক (তৃণভ‚মির বাইনসন, শুধু তোমাদের জন্য, পবিত্র নারীরা), প্রেমের উপন্যাস (সবুজ পাহাড়, প্রেম আমার প্রেম, ঝড়ের মুখোমুখি, হে মানব মানবী, অতলান্ত নীল, গোলাপ তবু তুমি, বান্ধবী প্রিয়দর্শিনী ও চন্দ্রাহত, অন্ধকারে বেতোফেন); রাজনৈতিক উপন্যাস (সীতা পাহাড়ে আগুন, হারুন ফেরেনি, সুপ্রভাত সোনালি দিন, জগৎ জুড়িয়া কান্দে, জ্যোৎস্নার নীল সীমানা, সীতা পাহাড়রে আগুন, ডাইম নিকেল); শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ১ (ঘর ভাঙা ঘর, শিলায় শিলায় আগুন, সূর্য সবুজ রক্ত ও রক্তের অক্ষরে লেখা, উত্তম পুরুষ, ধবল জ্যোৎস্না, একাল চিরকাল ও বাঘবন্দি)। হাসির উপন্যাস প্রজাপতি নিবন্ধন; আত্মজৈবনিক (অভিবাসী আমি, নদী নিরবধি, প্রাচীন নগরীতে যাত্রা), গল্প সংকলন (অগ্নি স্বাক্ষরা, নির্বাচিত গল্প) দূরে কোথাও, প্রিয় গল্প, চার দশকের গল্প) রম্য গল্প সংকলন (খাওয়া-খায়ির বাঙলি); শিশুতোষ (ঝিলিমিলি তারা, রাজার ছাড়া, মতিশীরে বাড়ি ও অন্যান্য গল্প, আজব ঘড়ির দেশে)।
তেত্রিশটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করলেও সবচেয়ে বেশি আলোচিত উপন্যাস হলো বং থেকে বাংলা, রক্তের অক্ষরে লেখা, আঁবে রওয়া, সূর্য সবুজ রক্ত। রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষর ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত উপন্যাস।
রক্তের অক্ষর
নয়টি অধ্যায়ে বিভাজিত এক শ বারো পৃষ্ঠার রক্তের অক্ষর উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে গোলাপিপট্টি নামে একটি পতিতালয়কে ভিত্তি করে। যদিও পতিতালয়টি কোথায়, সে-রকম স্থান ও নিষিদ্ধপল্লির প্রেক্ষাপটের বর্ণনা নেই; তথাপি ধরে নেওয়া যায় পুরান ঢাকার প্রবেশমুখে ইংলিশ রোডে অবস্থিত সেই সময় পতিতালয়ের ঘটনাবলিই এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। বাংলাদেশের বৃহৎ এই নিষিদ্ধপল্লি স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তৎপরতায় উচ্ছেদ করা হয়। ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনায় নিষিদ্ধপল্লির যৌনকর্মীদের জীবনাচার, অর্থাভাব, দুঃখ-দুর্দশা, মাস্তানদের নির্যাতন, বিকৃত ধর্ষকামী পুরুষের অকথ্য নির্যাতন, রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাহীন মৃত্যু, অস্বাস্থ্যকর জীবনের চালচিত্র, পূতিগন্ধময় পরিবেশ এবং অশ্লীল গালিগালাজ ইত্যাদি বিষয়গুলো চিত্রিত হয়েছে এই উপন্যাসে। উপন্যাসের মাঝামাঝি গিয়ে পাঠক শান্তশিষ্ট, ভদ্র, শিক্ষিত, রুচিশীল ও মার্জিত যে কিনা অন্যান্য যৌনকর্মীর মতো খিস্তি করে না, পুরুষদের ধরার জন্য নানা রকম ফাঁদ পাতে না, গলির মুখে দাঁড়ায় না, কারও সঙ্গে অভদ্র আচরণ করে না, এ-রকম একজন যৌনকর্মীর সঙ্গে পরিচিত হয়, যার নাম ইয়াসমীন। উত্তর-স্বাধীনতা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থঅ ছিল গভীর সংকটে নিমজ্জিত। বলা বাহুল্য যে, আজকের বাংলাদেশে বসে সত্তর দশকের বাংলাদেশকে ভাবা কঠিন। কিন্তু উপন্যাসে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের তীব্রতা এই উপন্যাসে প্রকাশ পায়নি, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ ও লঙ্গরখানার উল্লেখ থাকায় কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় মাত্র।
যদিও ইয়াসমীনই এই উপন্যাসের প্রাণভোমরা, তাকে কেন্দ্র ও প্রতিপাদ্য করে এটি নির্মিত; তথাপি রিজিয়া রহমান একজন কৌশলী কথাশিল্পী হিসেবে প্রথমেই পাঠকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করাননি। তিনি প্রথমে নিষিদ্ধপল্লির বাস্তবানুগ প্রেক্ষাপট ও আবহ তৈরি করে, এই পল্লির একজন বাসিন্দা হিসেবে তাঁকে নির্মাণ করেছেন এবং উপন্যাসের স্তরে স্তরে অন্যান্য পতিতার জীবনকাহিনির সঙ্গে ইয়াসমীনের জীবনালেখ্য গ্রন্থটি করেছেন। সাধারণ উপন্যাসের কাঠামোতে আমরা দেখি, প্রথমেই কেন্দ্রীয় চরিত্রের আবির্ভাব এবং তাকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসটি এগিয়ে যায়, এই উপন্যাসে সে-রকম পরিলক্ষিত হয়নি। ইয়াসমীনের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে উপন্যাসের বত্রিশ পৃষ্ঠায় এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইয়াসমীনের নিষিদ্ধপল্লিতে তার যাপিত জীবনের সূচনা ঘটে। উপন্যাসের শুরুটা হয়।
সকালটা এখানে অকেজো নেশাখোরের মতো ঝিম ধরে পড়ে আছে। পলেস্তরা খসা ইট বের করা দেওয়ালে সরু রোদের রেখা বিনা পয়সার খরিদ্দারের মতো বেহায়াভাবে লুটোপুটি খাচ্ছে। ময়লা উপচানো ড্রেনের ধারে কয়েকটা শালপাতা ঠোঙা আর ছেঁড়া তেল-চপচপে কাগজ নিয়ে গৃহবিবাদে রত একদল কাক। একটু দূরেই একটা ঘেয়ো কুকুর কুÐলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। আর কোনো শব্দ নেই। [রক্তের অক্ষর, পৃ. ৭]
প্রথম প্যারাতেই লেখকের তীক্ষ অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায় এবং প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য এমন জীবন্ত ছবি নির্মাণ কেবল দক্ষ লেখকের পক্ষেই সম্ভব। পতিতালয়ের একেকজন যৌনকর্মীর একেক রকম আচরণের যে কল্পচিত্র মূর্ত, তাতে মনে হয় চোখের সামনেই সবকিছু ঘটছে। প্রথমেই তিনি উপন্যাসের ক্যানভাসে রং চড়িয়ে দিয়েছেন এবং পরে চরিত্রগুলোর ছবি গভীর মনোযোগ দিয়ে চিত্রিত করেছেন। ডার্ক ইমোশনের বিষাদের নীল রং চড়িয়ে ইয়াসমীনের চরিত্রটিকে জীবন্ত করেছেন লেখক। এই চরিত্রের মধ্যে একাধারে অস্তিত্ববাদ ও অভিব্যক্তিবাদ দর্শনের আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হয়েছে। ইয়াসমীনকে প্রথমে দেখা যায়, বেঁচে থাকার জন্য সমাজের প্রতিটি জায়গায় নিগৃহীত হয়ে শেষ পর্যন্ত পতিতালয়ে সে আশ্রয় নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বিদ্রোহী হতেও দেখা যায়।
রক্তের অক্ষর উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদে বিভিন্ন রকম শরীরের বর্ণনা যেমন পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি তাদের অশ্লীল ও কদর্য ভাষার ব্যবহারও রাখঢাক ছাড়া অকপটে বর্ণনা পাওয়া যায়। এই ধরনের উপন্যাস লেখার সেই সময়ে লেখক যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্যে একজন নারী লেখকের পক্ষে বিরল ঘটনা। অবশ্যই আধুনিক উপন্যাসে এই ধরনের বর্ণনা, পাত্রপাত্রীর বাস্তবসম্মত সংলাপের ভাষা উপেক্ষিত হতে পারে না; বরং আধুনিক সাহিত্যের দাবি তিনি অনিবার্য শর্তে তা পূরণ করেছেন। এই ন্যারেটিভের মধ্যেই তিনি নারী হিসেবে নয়; বরং একজন কীর্তিমান আধুনিক লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইয়াসমীনের চরিত্রটি পাঠকের মনে কৌত‚হলের উদ্দীপনা সঞ্চার করলেও তার সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় না। একজন আধুনিক শিক্ষিতা, মার্জিত নারী যে কিনা প্রতিদিন পত্রিকা পড়ে, উপন্যাস পড়ে, ইংরেজি উপন্যাস তার সম্পূর্ণ আখ্যানে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়।
কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত, নিগৃহীত, দারিদ্র্যপীড়িত নারীদের বেশির ভাগই প্রতারণার শিকার হয়ে পতিতালয়কে শেষ আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করে, আবার কেউ কেউ স্বেচ্ছায়ও এখানে আসে বেঁচে থাকার জন্য। কথাশিল্পী রিজিয়া রহমান এ-রকম কয়েকটি মেয়ের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আবার এ-কথাও সত্য, জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে অনেক যৌনকর্মীর রোজগারের টাকায় তাদের পরিবার চলে; এ-রকম দু-তিনটি ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। ধর্ষকামিতা ও বিকৃত যৌনাচারের রূপও কত বিচিত্র, মানুষের ভেতরের রূপ যে কত রকম, রিজিয়া রহমান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন এই উপন্যাসে। এক যৌনকর্মীকে চাবুক দিয়ে পেটানোর মধ্য দিয়ে ধর্ষকামিতার বিকৃত যৌনাচারের একটি রূপ পাওয়া যায়। কলকাতার গবেষক ও লেখক কৃষ্ণা দত্ত ‘লাল বাতির নীল পরিরা’ গবেষণাগ্রন্থে পৃথিবীর অনেক দেশের যৌনকর্মীদের ওপর বিকৃত যৌনাচারের বর্ণনা করেছেন। এই গ্রন্থে’ যে-ধরনের জঘন্য, হিংস্র ও ভয়াবহ যৌনাচার বর্ণিত হয়েছে, তারই একটি রূপ এই উপন্যাসে চাবুক দিয়ে পেটানোর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষের ঘটনাও একটি প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে। চুয়াত্তর সালের বন্যা-পরবর্তী সময় ব্যাপক ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলাদেশে ওই দুর্ভিক্ষ ছিল ভয়াবহ। বেঁচে থাকার সংগ্রামে অনেক নারী তখন যৌনপল্লিতে আশ্রয় নিয়েছিল। এরই একটি বর্ণনা পাওয়া যায়:
দুর্ভিক্ষের আগেই পারুলের বাবা মরেছে। বেঁচে থাকতে মানুষের ক্ষেতে কামলার কাজ করত। জমিজমা ছিল না এক কানিও। আকালের সময় ছেপড়া ঘরসমেত ভিটাও বেচে দিল। তারপর অনেকগুলো সৎ ভাই-বোন আর সৎমার সঙ্গে পারুল শহরে এলো। এখানে-সেখানে স্রোতের শ্যাওলার মতো ভাসতে ভাসতে অবশেষে এলো এই মোক্ষম স্থানে। না খেয়ে শহরের পথে হাঁটতে থাকা ক্লান্ত ক্ষুধার্ত অবসন্ন পারুলের দাম যাচাই করে ফেলল সৎমা। লঙ্গরখানার ভাত-ডালের লোভ দেখিয়ে মাত্র তিরিশ টাকায় বেচে দিল পারুলকে। ক্ষুধার্ত পারুলের অবসন্ন দেহটা কিনে নিল মেয়ে ব্যবসায়ীরা। পারুলের তাতে আক্ষেপ নেই। ক্ষুধার জ্বালার কষ্ট, সৎমায়ের লাঞ্ছনা-গঞ্জনার হাত থেকে সে বেঁচে গেছে। [তদেব, পৃ. ৪৮]
এটি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হলেও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার বর্ণনা এখানে খুব সামান্যই স্থান পেয়েছে। তবে যুদ্ধের গল্প বা উপন্যাস লিখতে গিয়ে যুদ্ধের বর্ণনা করতে হবে, সে রীতির পক্ষে আমরা সাকল্যে একমত নই। ভ‚মিকাপর্বে আমরা সে ধারণা দিয়েছি। একটি যুদ্ধের আগে ও পরে থাকে অনেক ঘটনার ঘনঘটা। যুদ্ধের আগে প্রেক্ষাপট তৈরি হয় এবং যুদ্ধোত্তর মানুষের মধ্যে তার ইমপ্যাক্ট বা প্রভাব থাকে। ইমপ্যাক্ট মূলত যুদ্ধের ফসল। তাই রক্তের অক্ষর উপন্যাসে স্বাধীনতা-উত্তর মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা চিত্রিত হয়েছে এক তরুণীর বুকে ধারণ করা মর্মš‘দ নীরব আর্তনাদ, হাহাকার, পাকসেনাদের পৈশাচিক নির্যাতনের বেদনা, আপন চাচার প্রতারণা ও বঞ্চনার কষ্ট, প্রেমিকার বিচ্ছেদের বিষাদ, আত্মীয়স্বজনের অবজ্ঞার নির্দয় মর্মপীড়া।
যুদ্ধ মানে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, নারী নির্যাতন, রক্তে ভেসে যাওয়া জনপদ, হাজার হাজার মানুষের পঙ্গত্ব বরণ, সম্পদহীন হওয়া, নিজস্ব আবাস্থল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, অবকাঠামো বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক। এসব হলো বাহ্যিক। কিন্তু যুদ্ধোত্তর মানুষের ট্রমা, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক টানাপোড়েন, মনস্তাত্তিক সংকট ইত্যাদি বিষয়ও যুদ্ধের পরিণতি। আর এসবই মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের উপাদান। এই হিসেবে বক্ষমাণ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সামান্য একটি ঘটনার বিবরণ থাকলেও যুদ্ধোত্তর মানুষের পরিবর্তিত স্বার্থবাদিতা, বদলে যাওয়া চরিত্রের বর্ণনা এবং সর্বোপরি ইয়াসমীনের ট্রমাটিক জীবনাচারের বাস্তবানুগ বিষয়-আশয় বর্ণিত হয়েছে।
শিল্পের খাতিরে ক্যাম্পের নির্যাতনের কোনো বর্ণনায় লেখক যাননি। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে অনেকে ক্যাম্পের বীভৎস বর্ণনা করেছেন, আবার কেউ এ দেশের অসহায় নারীদের শরীরেরও নির্যাতন বর্ণনা দিয়ে তাদেরকে আর ক্লেদাক্ত করতে চাননি। ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ জীবনীমূলক গ্রন্থে নারী নির্যাতনের যে নৃশংস, বীভৎস, কুৎসিত ও জঘন্য বর্ণনা পাওয়া যায়, তা পাঠককে অস্তির করে তোলে। ‘নেকড়ে অরণ্য’ ও ‘জলাঙ্গী’ উপন্যাসটিতেও পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা পাওয়া যায়। মানবিকতার খাতিরে ক্যাম্পের জঘন্য বর্ণনা না দিলে টর্চার সেলের অবস্থা কেমন ছিল, তা অজানাও থেকে যেতে পারে। নাৎসিদের গ্যাস চেম্বার কেমন ছিল, তার বর্ণনা নৃশংস ও পৈশাচিক হলেও জীবিতদের জন্য সাহিত্যের এর বর্ণনা থাকারও যুক্তি আছে। তবে স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া যায় ধর্ষণ, লাঞ্ছনা, শারীরিক নির্যাতন, অনাহারে থাকা, বস্ত্রহীন রাখা এসব ছিল পাকসেনাদের ক্যাম্পের নিত্যদিনের ঘটনা।
ইয়াসমীনের বীরাঙ্গনা থেকে বারাঙ্গনা হওয়ার মর্মান্তিক ও নিষ্ঠুর ঘটনাটি জানা যায় এই উপন্যাসের ষষ্ঠ অধ্যায়ে, ৮৩ পৃষ্ঠায়। এর পূর্বে গোলাপিপট্টির বেশ কিছু নারী চরিত্র, বিশেষ করে বকুল, জাহান আরা, জরিনা, মাসি, সখিনা, শান্তি, মনু, কুসুম, হুরী, পারুল, গোলাপি অধিকাংশ পৃষ্ঠা দখল করে আছে। পুরুষ চরিত্রের মধ্যে দেলোয়ার, লেখক ও সাংবাদিক উপন্যাসের মাঝামাঝি পাঠকের সামনে হাজির হয়েও একটি শক্তিশালী চরিত্র, বলা যায় প্রোটাগনিস্ট হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে এবং এন্টাগোনিস্ট হিসেবে উপন্যাসের শেষের দিকে ভয়ংকর রূপে আবির্ভুত হয় হিরু। পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় নিষিদ্ধপল্লির দুর্বিষহ জীবনের হাহাকারের বর্ণনা। একটি ভদ্র পরিবারের শিক্ষিত নারী ইয়াসমীনের জন্য তা কতটুকু যন্ত্রণাদহ ছিল, তা লেখকের বর্ণনায়
[…] এ পাড়াটা শব্দ আর গন্ধের জগৎ। গুন্ডা, দালাল, চিৎকার, কান্না, ঝগড়া, চটুল হাসি আর পাশবিকতার জগৎ। এ সময় মাঝে মাঝে ইয়াসমীনের দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় সারাটা পৃথিবী এখন এক পশুর হিংস্র থাবায় বলের মতো গড়াগড়ি খেয়ে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। ইয়াসমীনের তখন নিজের গলাটা টিপে ধরতে ইচ্ছে করে। অদৃশ্য কোনো শক্তির কাছে বোধশক্তি-রহিত জড়ব¯‘ বা দৃষ্টিহীন জš‘ যাবার প্রার্থনা করতে ইচ্ছে হয়। ইয়াসমীন তো অন্ধ হয়ে যাবার জন্যই এখানে তাড়িত হয়েছিল। তবু বিবেক কেন চাড়া দিয়ে ওঠে বিদ্রোহে! [তদেব, পৃ.৩৫-৩৬]
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভাগ্যবিড়ম্বিত ইয়াসমীন ছিল চাকরিজীবী বাবার সন্তান। তার বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ২৫শে মার্চের কালরাতে শহিদ হন। তখন তারিক নামে তার এক প্রেমিক ছিল। ইয়াসমীনের ভাইয়ের বন্ধু ছিল কামাল, সে ছিল মুক্তিযোদ্ধা। এক রাতে কামাল ইয়াসমীনদের বাসায় আশ্রয় নিলে বাসার চাকর আলী পাক হানাদারদের খবর দিলে ওরা বাসায় আক্রমণ করে। কামাল আক্রমণের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। আর ক্ষুদ্ধ হানাদাররা ইয়াসমীনের সামনেই বাবা-মাকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে এবং তাদের লাশের ওপর দিয়েই তাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর কী ঘটেছিল, তা হয়তো কোনো সচেতন মানুষেরই অজানা হয়। যুদ্ধের সময় যেসব তরুণীকে বলপূর্বক ক্যাম্পে বন্দি করে রেখে নির্যাতন করেছে, তাদের জীবনের মর্মস্পর্শী কাহিনি শুনলে অন্তরাত্মায় কাঁপন সৃষ্টি হয়। পাঠকের মনে বিষাদের নদী প্রবাহিত হয়। ইয়াসমীনের জীবনের ঘটনাটি গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে এমনই মনে হওয়ার কথা। লেখকের ভাষায়,
বাবা বেয়নেটের আঘাতে দরজার সামনেই মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকটিকে আশ্রয় দেবার অপরাধে শাস্তি থেকে বাড়ির কেউ রেহাই পায়নি। বাবা-মা, ভাইবোন অনেকগুলো রক্ত বয়ে যাওয়া মৃতদেহের ওপর দিয়ে ইয়াসমীনকে হিঁচড়ে এনে জিপে তোলা হয়েছিল। আর তোলা হয়েছিল চাকর আলীকে। জিপে উঠে ইয়াসমীন জেনেছিল আলীই হানাদার সেনাদেরকে কামালের খবর দিয়ে এসেছিল। [তদেব, পৃ. ৮৩]
ইয়াসীমন আত্মদহন ও পীড়নে বারবার জর্জরিত হয়। সে যেন কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের মতো এখানে ছিটকে পড়েছে। আত্মগ্লানিতে ডুবে হাহাকার করে ওর অন্তর। বীরাঙ্গনারা দেশের আর দশটির মতো নিষ্কলঙ্ক নয়, নিষ্পাপ নয় এ-রকম আত্মবিলাপের মধ্য দিয়ে ইয়াসমীনের যন্ত্রণাকে উপশম করে, মেনে নেয় নিষিদ্ধপল্লির কদর্য জীবনকে।
ইয়াসমীন আর দশজন যৌনকর্মীর মতো নয়। সে রুচিশীল, মার্জিত, বিনয়ী ও ভদ্র। নিয়মিত পত্রিকা, বই, ইংরেজি বই পড়ত, শান্ত মেজাজের পাড়ার সবাই তাকে সমীহ করত, শ্রদ্ধা করত। ঠান্ডা যৌনতার ইয়াসমীন দিনের বেলায় কোনো পুরুষকে বসায় না, রাতেও সিলেকটিভ কাস্টমার নেয়। তবে মেয়েদের ভাগ্য ফিরিয়ে নিতে কিছু কাজও শুরু করে। কিন্তু তার আর শেষ হয়নি।
ইয়াসমীনের চাচার চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একটি লোভী ও শঠ মানুষ হিসেবে। স্বাধীনতার পর আশ্রয়শিবির থেকে ইয়াসমীন চাচার সঙ্গে দেখা করতে গেলে চাচা যেন ভুত দেখার মতো অবস্থায় পড়ল। চাচা-চাচি তাকিয়ে তাড়িয়ে দিতেই পারলেই যেন বাঁচে। যদিও চাচা তাকে বাড়ি থেকে ভদ্রভাবে তাড়িয়ে দিয়ে একটি চাকরির চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তখনকার সময়ে অফিসে বসে থাকা মানুষরূপী জানোয়ারদের আচরণেও ইয়াসমীন মানুষ ও সমাজের প্রতি তীব্রভাবে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। চাচা ইয়াসমীনকে এক লোকের কাছে বিয়ে দেয়। দিনাজপুরের ওই লোকটির গ্রামের বাড়িতে আরেক স্ত্রী ছিল। চাচার সঙ্গে মিলে কৌশলে ইয়াসমীনের বাবার বাড়িটি ওই লোক লিখে নেয় এবং এক রাতে জোর করে মদ্যপান করিয়ে বন্ধুবান্ধবসহ তাকে ধর্ষণ করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এভাবে বারবার নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ও ধর্ষিত হয়ে তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে প্রায় মানসিক ভারসাম্যহীন ইয়াসমীনের শেষ আশ্রয় মেলে গোলাপিপট্টিতে।
লেখক ও সাংবাদিক এই উপন্যাসের একটি মহৎ চরিত্র সৃষ্টি করেছেন লেখক। দেলোয়ার পল্লিতে আসেন কিন্তু কোনো নারীর সঙ্গে মেলামেশা করেন না। শেষ পর্যন্ত ইয়াসমীনের দেখা পান। দেলোয়ারের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমেই পাঠক জানতে পারে ইয়াসমীনের জীবনের করুণ কাহিনি। অবশ্য দেলোয়ার একটি ফিচারও পত্রিকায় প্রকাশ করেন।
যুদ্ধোত্তর এ দেশের মানুষের চরিত্রও বদলে যায় রাতারাতি। এমনকি যে মুক্তিযোদ্ধারা দেশপ্রেমের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, তাঁদেরও অনেকে বদলে যায় অর্থ, ক্ষমতা আর মোহের অন্তরালে। যে কামালকে আশ্রয় দেওয়ার পর ইয়াসমীনকে পাকসেনারা হরণ করে এবং বাবাকে হত্যা করে, সেই কামালই যুদ্ধের পর আমূল বদলে যায়। সে একটি নিকৃষ্ট মানুষ রূপে আবির্ভূত হয়। জমি দখল, নারী ও মদাসক্ত ইত্যাদি অসামাজিক কাজে সে লিপ্ত হয়। ইয়াসমীনের ভাষায়,
[…] আমার যা হয়েছে তা নিয়ে এখন আর তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। আজকের যে তোমাকে দেখছিল, সে তোমাকে আমরা বাড়িতে আশ্রয় দেইনি। আমরা আশ্রয় দিয়েছিলাম একজন মুক্তিযোদ্ধাকে। যে দেশের জন্য, সবার জন্য যুদ্ধে গিয়েছিল। যার জন্য সেদিন বা-বাবা, ভাইবোন সবাইকে হারিয়েছি। আর আমি হয়েছি বেশ্যা। [তদেব, পৃ. ৯৯]
যুদ্ধোত্তর কামালের মতো অনেককে বিপথে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সেই সময়ের অনেক সচেতন মানুষেরই ছিল। কামালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাকে মদের বোতল দিয়ে মাথায় আঘাত করে লাঞ্ছিত, নির্যাতিত, সর্বহারা ইয়াসমীন কিছুটা আক্রোশ প্রকাশ করতে পারে, যদিও কামাল মারা যায়নি।
একদিন গোলাপিপট্টির মাস্তান হীরু অল্প বয়সী মেয়ে গোলাপিকে কিনে আনে এবং সে পতিতাবৃত্তিতে রাজি না হওয়ায় হীরুসহ আরও তিনজন পুরুষ বিবস্ত্র গোলাপিকে অমানুষিক নির্যাতন করার সময় তার আর্তচিৎকারে সারাটা পাড়া ভয়ে কাঁপতে থাকলেও ইয়াসমীন কয়েকজন যৌনকর্মীকে সংগঠিত করে প্রতিবাদ করতে গেলে হীরু তাকে পেটে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।
ইয়াসমীনের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই রক্তের অক্ষর উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে। শেষে কিছুটা নাটকীয়তা থাকলেও শেষ বাক্যের মধ্য দিয়ে নতুন একটি বার্তা তিনি দিয়েছেন। ইয়াসমীন যেন একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের প্রতীক। ইয়াসমীনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাঠকের মনে বিষাদের ছায়া পড়ে।
নিস্তব্ধ বজ্রাহত বাড়িটায় তখন একটি শিশুর স্বাধীন প্রতিবাদের কান্না বেজে উঠল। ফলমতীর বাচ্চা কাঁদছে প্রবল চিৎকারে। রূপকার্থে একটি শিশুর চিৎকার করে কান্নার মধ্য দিয়ে লেখক পাঠককে বার্তা দিচ্ছেন যে, এখন থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে এবং হীরুর মতো অত্যাচারীরা একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। গৌর কিশোরের ‘প্রেম নেই’ উপন্যাসেও একটি শিশুর জন্ম লক্ষ করা যায়।
নিঃসন্দেহে রক্তের অক্ষর উপন্যাসটির মোটিফ মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীর প্রতিচিত্র অঙ্কন করা। বিভিন্নভাবে জানা যায় যে, লেখক একটি ফিচারের ভিত্তিতে এই উপন্যাস রচনা করেন। তাই এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো কাল্পনিক হলেও ইয়াসমীনের মতো ভাগ্যবিড়ম্বিত অনেক নারী যৌনপল্লিতে আশ্রয় নিয়েছিল। এই বিবেচনায় এই উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ আরও বেশি স্থান দখল করতে পারত। কিন্তু উপন্যাসজুড়ে যৌনপল্লির আধিপত্যই বেশি থাকায় মহাকালে কখনো যদি কেউ এটিকে যৌনপল্লির উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করে, তখন কিছু করার থাকবে না।