একটি কালো মেয়ের কথা : তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়
বাংলা কথাসাহিত্যে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থাৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮) ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮) পৃথকভাবে আলোচনার ঝলমলে আসর স্থান সৃষ্টি করেছেন তাঁদের সাহিত্যকর্ম দিয়ে। পাশাপাশি সময়ে তিন প্রতিভাবান কথাসাহিত্যের জন্ম এবং তাঁরা তিনজনের সাহিত্যের ক্যানভাসে গ্রামবাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিচিত্র জীবনের চিত্র নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে। তাঁদের সাহিত্যপাঠ মানেই মনে হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জনপদ দিয়ে হেঁটে বেড়ানো, চরিত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলা। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি স্থান দখল করেছে রাঢ়বঙ্গের প্রান্তিকজন ও জনপদ। যে জনপদে তারাশঙ্করের পরবর্তীকালে হেঁটেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ।
অনস্বীকার্য যে, বাংলা কথাসাহিত্যে তারাশঙ্করকে বাদ দিয়ে সাহিত্যালোচনা ম্লান। তাঁর সৃষ্টিসম্ভার শুধু বিপুল নয়, ধ্রুপদী ধারার সাহিত্যিও তিনি সৃষ্টি করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। ভারতীয় লেখক তারাশঙ্কর কেবল ভারতের বাংলাভাষাভাষী সাহিত্যানুরাগীদের কাছে শীর্ষস্থানীয় লেখক নন, বাংলাদেশেও তাঁর জনপ্রিয়তা ও মর্যাদা শীর্ষ স্থানে রয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির (অধুনা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের) অন্তর্গত বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ছিল প্রভাবতী দেবী। তারাশঙ্করের বয়স যখন আট বছর তখন তাঁর পিতা প্রয়াত হন, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৯১৫ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে না পেরে ১৯১৬ সালে দ্বিতীয় বার পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর কলকাতায় প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ও পরে সাউথ সাবআর্বান কলেজে (এখন আশুতোষ কলেজ) ভর্তি হন। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে ও স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়াতে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আর হয়নি। তিনি ১৯১৬ সালেই মাত্র আঠারো বছর বয়সে উমাশশীকে বিয়ে করেন। তাঁদের ছিল দুই পুত্র ও তিন কন্যা। কিন্তু মধ্যম কন্যা মাত্র ছয় বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
লেখালেখির পাশাপাশি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, ১৯৩০ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদান করে তারাশঙ্কর গ্রেফতার হয়েছিলে; সেই বছর ডিসেম্বর মাসে কারাগার থেকে মুক্তিলাভও করেন এবং ১৯৬০ সালে রাজ্যসভার সদস্য নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৩২ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় তাঁর। এই মহান কথাসাহিত্যিকের লেখক জীবন যেমন পরিশ্রমের তেমনই বর্ণাঢ্য। তিনি কয়েকটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ আরও অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার অর্জন করেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় তিনি চীন ও রাশিয়া সফরও করেন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য-সম্মলনে নেতৃত্ব দেন।
ভাষার টানেই নাড়ির টান, শেকড়ের টান তো আছেই—সাতচল্লিশে পেন্সিলে কাটা মানচিত্র ভাগাভাগি হলেও সব বাঙালির নাড়ির টান কি কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন করা গেছে? দু’দেশের জনগণের পাশাপাশি কবিসাহিত্যিকদের অন্তরাত্মার টান যে কতটা নিবিড় তার প্রমাণ লেখার মধ্যেই পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হাসপাতালের শয্যায় শায়িতাবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মানুষদের প্রতি অমোঘ দরদ ও ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি লেখেন ‘একটি কালো মেয়ের কথা’ নামে নাতিদীর্ঘ উপন্যাস। উপন্যাসটি লেখার কিছু দিন পরেই তিনি দেহত্যাগ করেন এবং প্রকাশিত অবস্থায় তিনি এটি দেখে যেতে পারেননি, সে বছরের নভেম্বর মাসে সালে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে ডেইলি স্টার বুকস প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এই উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। ‘শিয়রে মৃত্যু রেখে দুটি উপন্যাস’—শিরোনামে হাসান আজিজুল হক এই উপন্যাসের ভূমিকা লেখেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের একজন দিকপাল, মহান লেখক। তিনি ৬৪টি উপন্যাস, ৩৭টি গল্পগ্রন্থ, ১০টি নাটক, ৮টি প্রবন্ধ এবং প্রহসন, ভ্রমণকাহিনি ও কাব্যগ্রন্থ একটি করে রচনা করে বাংলা সাহিত্যভান্ডারে যে অমূল্যরতœরাজি মজুদ করে গেছেন তা সাহিত্যামোদিদের জনম জনম ধরে খোরাক জুগিয়ে যাবে। তাঁর সমস্ত সত্তাই সাহিত্যে বিলীন হয়েছিলেন এবং আজীবন সাহিত্যসাধণায় আত্মমগ্ন এই লেখক সৃষ্টিও করেছেন ‘কালিন্দী’, ‘জলসাঘর’, ‘পাষাণপুরী’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, ‘গণদেবতা’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘প গ্রাম’, ‘সন্দীপন পাঠশালা (কিশোর উপন্যাস)’, ‘কবি’র মতো বিখ্যাত উপন্যাস। সাহিত্যকে তিনি জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন বলেই রোগশয্যায়, বলতে গেলে মৃত্যুশয্যায় থেকেও দুটি উপন্যাস লিখে বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর দুটি উপন্যাসের মধ্যে একটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘একটি কালো মেয়ের কথা’ এবং অন্যটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ‘সুতপার তপস্যা’। লেখকের শেষ ইচ্ছানুযায়ী এক মলাটে ‘১৯৭১’ নামে দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। মহান কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় ১৯৭১ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন।
একটি কালো মেয়ের কথা নব্বই পৃষ্ঠার নাতিদীর্ঘ উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয় উপন্যাসের নায়কের চোখের বর্ণনা দিয়ে যে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে গভীর রাতে ঢাকায় ক্র্যাক ডাউনের পরের দিন ঢাকা শহরে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও সারি সারি বীভৎস রক্তাক্ত লাশ দেখে দিশেহারা ডেভিড আর্মস্ট্রং নাজমা ও তার সন্তানকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সীমান্তে পাকিস্তানের গুপ্তচর সন্দেহে ভারতের থানায় ইন্টারোগশনের জন্য বসিয়ে রাখা হয়েছে তাঁর ক্যাটসআই চোখের বর্ণনার মধ্য দিয়ে। দেড় পৃষ্ঠার প্রথম অধ্যায়ে পাকিস্তানের গুপ্তচর সন্দেহের চরিত্রের নামোল্লেখ না করে নাটকীয় ও রহস্যময় চোখের বর্ণনার মাধ্যমে পাঠককে আটকানো হয় এবং পরের প্রতিটি অধ্যায়ে পুলিশের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সন্দেহভাজন গুপ্তচর (যদিও সে গুপ্তচর নয়) ডেভিড ঢাকার অপারেশন সার্চ লাইটের ভয়াবহ বর্ণনাসহ তার জীবনের কাহিনি এবং নাজমার সঙ্গে জড়ানোর ঘটনাগুলো পর্যায়ক্রমে উন্মোচন করে। ছোটো বড়ো মোট সতেরোটি অধ্যায়ের মধ্যে আখ্যানটি রচিত হয়েছে।
উপন্যাসের মূল কথক রেডিও ম্যাকানিক্স ভাগ্যবিড়ম্বিত ডেভিড হলেও তার সমস্ত বক্তব্যই গৃহীত হয়েছে থানার দুজন পুলিশের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে। থানায় স্থানীয় যুবক যারা তাদেরকে গুপ্তচর সন্দেহে ধরেছে তারও সেখানে উপস্থিত ছিল। উপন্যাসের শুরুতেই সন্দেহভাজন ব্যক্তির চোখের বর্ণনা দিয়ে লেখক উল্লেখ করেন,
‘ক্যাটস-আই’ বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। অবিকল বেড়ালের চোখের মত। সাদা-ক্ষেতের মধ্যে খয়েরী রঙের গোল ঘেরের মধ্যে মণি দুটো ঠিক কালো নয় ঈষৎ নীলচে বেড়ালের চোখ যেমন আলোয় নিষ্প্রভ হয়ে আসে ও অন্ধকার হলেই জলজলে হয়ে জ্বলে ওঠে এর চোখ দুটোও ঠিক তেমনই, কড়া কথা হলেই প্রদীপ্ত হয়ে উঠছিল। পিঙ্গলাভ গোল তারা দুটোর মধ্যে যেন আলোর ছটা পাওয়া কালো পাথরের মত মনে হচ্ছিল। [পৃ. ১১]
চোখের বর্ণনার পরই লেখক তার শারীরিক বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন,
খাড়া নাক, লম্বা ধরনের মুখ; হাড়ে মাংসে পেশীতে পাকানো শরীর, প্রায় পৌনে ছ’ফুট লম্বা, বুকের ছাতিখানা এতখানি প্রশস্ত, গায়ের রঙ তামাটের চেয়েও কালো কিন্তু কানের পেটীর ফাঁকে ফাঁকে-গলা এবং চিবুকের ভাঁজের রেখায় এককালের ফর্সা রঙের চিহ্ন শেওলাধরা পুরনো থামের মাথার পাখির-কাজের সাদা ফলির মত চোখে পড়ে। পৃষ্ঠা ১১
ডেভিডের দৈহিক বর্ণনায় সাধারণ বাঙালিদের বৈশিষ্ট্য ফুটে না ওঠাতে পাঠকের মধ্যে কৌতূহল দেখা দিতে পারে সে সত্যি গুপ্তচর কি না। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তাঁর উসকুখুসকো চুল ও কাপড়চোপড়ের বর্ণনাতেও গুপ্তচর সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
ভারতীয় পুলিশের এক প্রশ্নের উত্তরের ডেভিডের বর্ণনায় উঠে আসে লাশ আর লাশ দেখে ঢাকায় থানা নিরাপদ মনে করাতে জীবন বাঁচানোর জন্য ডেভিড আর্মস্ট্রং নাজমার দুই বছরের ছেলেসহ তিনজন গোপন পথে ভারতে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। পথে পথে নানা বাধাবিপতি পেরিয়ে সীমান্তের ওপারে গেলে ডেভিডের চেহারা দেখে তাকে গুপ্তচর সন্দেহে সীমান্ত এলাকার কয়েকজন তরুণ ডেভিড ও নাজমাকে থানায় সোপর্দ করে। সে স্পাই নয় তা প্রমাণ করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে এবং বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষার মিশ্রণে চলতে থাকে কথোপকথন, জীবনের কথা আর এভাবেই উপন্যাসের কাহিনিও এগিয়ে যেতে থাকে।
‘তুমি কি পাকিস্তানী নও?’ পুলিশের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ডেভিড যা বলেছে তাতে সন্দেহ আরও দানা বাঁধে। ডেভিড বুঝাতে চেয়েছে যে, চব্বিশ বছর ধরে পাকিস্তানের দানাপানি খেয়ে বড়ো হয়েছে তাহলে কীভাবে পাকিস্তানী নয়। তখনই স্থানীয় এক যুবক তার গালে কষে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে উদ্ধত কণ্ঠে গালাগাল দেয়। তবে ডেভিড সহজে ওই যুবকের রূঢ় আচরণ ও থাপ্পড় সহজে মেনে নেয়নি, সে প্রতিবাদ করে জানতে চায় কেন তাকে মারা হয়েছে। পোশাক ও চেহারার পাশাপাশি ডেভিড ইংরেজি, উর্দু ও বাংলার ভাষার মিশ্রণে কথা বলার কারণেও তাকে স্পাই সন্দেহ করাটা অমূলক নয়। ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তা ও যুবকরা ভালোভাবেই জানে যে, সাধারণত বাঙালিরা এমনভাবে মিশ্রিত ভাষায় কথা বলে না। এমন একটি সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে পুলিশ কর্মকর্তাদের ইন্টারোগেশনের এক পর্যায়ে ডেভিড নিজেকে তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য তার জীবনের সব সত্য কথা বলতে শুরু করে এবং তখন কালো মেয়ে অর্থাৎ নাজমা পুত্রশোকে কাতর ও ক্লান্তশ্রান্ত দেহটি নিয়ে বেহুঁশের মতো পড়ে থাকে থানার মেঝেতে। ডেভিডের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা ও যুবকদের মধ্যে কী ঘটছে তা নাজমার বোধের সীমানায় পৌঁছাতে পারেনি।
ডেভিড আর্মস্ট্রং একজন এঙ্গলো ইন্ডিয়ান যার বাবা ছিলেন এঙ্গলো ইন্ডিয়ান এবং মা বাঙালি খ্রিষ্টান। স্বপ্নবিলাসী বাবা ছিল ইয়ার্ড অফিসার আর মা হাসপাতালের নার্স। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর তারা করাচি চলে যায়। ডেভিড বলে,
“মা হঠাৎ হার্টফেল ক’রে মারা গেল, বাবা আবার বিয়ে করলে শুকনো চেহারার নিষ্ঠুর মেজাজের এক আধবুড়ী খাস মেমসাহেবকে ধহফ ও ধিং ষবভঃ ধষড়হব, ধ ভড়ৎংধশবহ পযরষফ সারি দুনিয়ামে মেরা কুই নেহিথা! অবশ্য পযরষফ তখন আর আমি নই। বয়সে পনের পার হচ্ছি দুনিয়ার একটা আলাদা টান মনকে টানতে শুরু করেছে। জিন্দেগীর অনেক মন্দ জিনিষ গোপনে গোপনে জেনিছি। রাত্রে মিশন থেকে বেরিয়ে পালাতে গিয়ে ধরও পড়েছি দু-চারবার। গানের গলা ছিল-সিনেমার গান শিখেছি। উর্দু গান ভাল লাগছে। গজল গাই। এসব ফাদারদের অজানা ছিল না। এর উপর বাবা হঠাৎ চলে গেল ঊহমষধহফ-আমার খরচের জন্য এক পয়সাও দিয়ে গেল না। তবুও মাসচারেক ফাদাররা কিছু বলেনি। পাঁচমাসের সময় আমি মিশনের জিনিষ চুরি ক’রে ধরা পড়লাম।” [পৃ. ১৫]
মূলত, ডেভিড শৈশব থেকেই বাবা-মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত এক শিশু। মিশনারি স্কুলে ছিল অনেক কড়াকড়ি নিয়ম এবং রীতিমতো ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ছিল বাধ্যবাধকতা। কিন্তু ডেভিডের ধর্মীয় আচারাদি ভালো লাগত না, ধর্মের প্রতি তার তেমন জোরালো বিশ্বাস ছিল না, ভক্তিও ছিল না। এজন্য ধর্মীয় কাজে ছিল তার প্রচ- অনীহাত। পক্ষান্তরে, লেখাপড়াতেও ছিল অমনোযোগী। মা-বাবার আদর-সোহাগবি ত শিশুরা এ-রকম অমনোযোগী হবে তা স্বাভাবিক। লেখক চরিত্রটিকে এভাবেই বিশ^স্ত ও বাস্তবধর্মী করে নির্মাণ করেছেন। টাকার অভাব, সাবার কেনার টাকা পর্যন্ত নেই এমন দুরবস্থায় বিপর্যস্ত কিশোর ডেভিড চুরি করতে গিয়ে ধরা খায়। বাল্ব চুরি করে ক্ষমা পেয়েছিল সে। কিন্তু তারপর আরও দুবার চুরি এবং বিছানার নিচে উলঙ্গ মেয়ের ছবিসহ আরও আজেবাজে কাগজপত্র পাওয়াতে তাকে হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়া হয়। সে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিল, গান করতে পারত, গজল গাইতে পারত, গান রেকর্ডও করতে পারত। ঘটনাচক্রে এক বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে দেখা হয় এবং সেখানে থাকতে থাকে। ওদের মনসুর নামে একটি ছেলে যে মারা যাওয়ার পর স্বভাবতই তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল এবং ডেভিডকে আপত্য ঘরে স্থান দেয় এবং মৃত ছেলে মনসুরের নামটি তাকে দেওয়া হয়। ওরা মনসুর নামে তাকে ডাকত। ওদের সঙ্গে কিছুদিন থাকার পর এক সময় ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে চাকরি হয়। ঘটনাচক্রে, এই অফিসের অফিসার জাফরুল্লাহর সঙ্গে পরিচয় হয়, গজল গাওয়ার গুণের কারণে বন্ধুত্ব হয় এবং ষাটের দশকের শুরুর দিকে জাফরুল্লাহ তাকে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসার জন্য প্রস্তাব দিলেও সে তার সঙ্গে না এসে পরে আসে। কিন্তু ডেভিড কয়েক মাস পরে একদিন চলে আসে প্রথমে চট্টগ্রামে এবং সেখানে কিছুদিন থাকা পর ঢাকা। এসে পুরা বাঙালি হয়ে যায়।
কাহিনি নির্মাণে তারাশঙ্করের জুড়ি মেলা ভার। না-হয় একজন কথাসাহিত্যের কাহিনি নিয়ে ত্রিশটি চলচিত্র নির্মাণ কোনো সাধারণ কথা নয়। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে শয্যাশায়ী অবস্থাতেও তিনি কানিনি নির্মাণে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তবে এই নির্মাণটি লেখকের অন্যান্য উপন্যাসের মতো নয়। ডেভিডের কথনের মধ্য দিয়ে সব চরিত্রের বর্ণনা চিত্রিত হয়।
এই আখ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র জাফরুল্লাহ। সে লাহোরের এক খান্দানি পরিবারের লোক ছিল, ডেভিডের কোম্পানির অফিসার ছিল, আমোদফুর্তি করেই সময় কাটাত। ক্রিকেট, গাজবাজনা, শিকার, বেড়ানোই ছিল তার নেশা। লাহোর-করাচী ও রাওয়ালপিন্ডিতে ঘুরে বেড়াত মনের আনন্দে। জাফরুল্লাহ ১৯৬২ সালের দিকে পূর্ব পাকিস্তানে নিজে কোম্পানি করার জন্য চলে আসে। জাফরুল্লাহ চরিত্রের মাধ্যমে লেখক তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দাপট ও নব্য সামন্ত-মানসিকতা এবং অর্থনৈতিক শোষণের কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছে। জাফরুল্লার চরিত্রের মাধ্যমেই পাঠক কিছুটা আঁচ করতে পারবেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে পূর্ব পাকিস্তানিরা ছিল অবেহেলিত ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয়।
জাফরুল্লাহর চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধকালীন রাজাকারদের চরিত্র চিত্রিত করেছেন। এই জাফরুল্লাহ যেন মুক্তিযুদ্ধের ঘোর বিরোধিতাকারী, অখ- পাকিস্তানের পক্ষে সাফাই গাওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের দালাল আখ্যায়িত করা, হিন্দুদের কাফের ফতুয়া দেওয়া অকথ্য নির্যাতন, ধর্ষণ, সম্পদ লুট, স্বাধীনতাকামী মানুষের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া ইত্যাদি কুকর্মের প্রতিনিধি রাজাকারদেরই প্রতিনিধি।
বোহেমিয়ান ডেভিড এক দিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চলে আসে প্রথমে চট্টগ্রাম, পরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে থিতু। সে গায়ক। উর্দু গজল গায়, ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করে কোনো মতে চলতে পারে। এ দেশে আসার পর ডেভিড আরও বদলে যায়। মায়ের দেশ পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার পর এদেশের জলমাটিবাতাস যেন তাকে দ্রুত বদলে দিতে থাকে। ঢাকা বেতারের ভাওয়াইগান, রবীন্দ্র সংগীতে সে বিমোহিত হয়ে যায় এবং নিজেও এসব গান গাইতে শিখে।
গানপাগল প্রেমিকা হিন্দু মেয়ে ছায়া মূলত ডেভিডের গানের জন্যই পাগল হয়ে যায় এবং প্রেম ও বিয়ের মাধ্যমে দুজনে ঘর বাঁধে। বিয়ের পর ছায়ার উৎসাহে সব ধরনের বাংলা গানও শিখে। রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং অকৃত্রিম মমতায় শিখতে থাকে। নতুন একটি স্বপ্নের ভুবনে তারা জীবনকেও যেন সংগীতময় করে তুলতে যাচ্ছিল। জীবিকার জন্য রেডিও ট্রানজিস্টার মেরামত করে, তৈরিও করে। ছায়ার চরিত্রটিও চিত্রিত হয়েছে মানবিক নারী হিসেবে। ছায়া তাদের বাসার নিচে থাকতে দিয়েছিল এক অন্ধ ভিখারিকে যার সঙ্গে ছিল একটি ছিপছিপে মায়াবী চোখের অধিকারিণী কালো কিশোরী মেয়ে নাজমা। একটি কালো মেয়ে, নাজমা এক অন্ধ ভিক্ষুক রহিমের মেয়ে। নাজমা গান করত অপূর্ব কণ্ঠে। নাজমার গানে আকর্ষণেই ছায়া ওদেরকে বাড়ির নিচতলায় থাকতে দিয়েছিল এই পরিবারটিকে। নাজমা কালো হলেও তার শারীরিক গড়ন ও সৌন্দর্য দৃষ্টিকাড়া। যৌবনবতী হলে অন্ধ ভিক্ষুক বাবাকে ফেলে সে এক যুবককে পালিয়ে বিয়ে করে এবং নাজমার একটি পুত্রসন্তানও হয়। কিন্তু ছায়া ও ডেভিডের সুখ স্থায়ী হয়নি। ছায়া এক সময় অসুস্থতায় মারা যায়। ছায়ার মৃত্যুর পর প্রেমিকপুরুষ প্রেমকাঙাল ডেভিড প্রায় পাগলের মতো হয়ে যায়। ছায়ার প্রতি ডেভিডের প্রেমের গভীরতা যেন লেখকের প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘কবি’র নায়ক কবিয়াল বসনের (বসন্ত) কবিয়াল নিতাইয়ের ছায়া প্রক্ষেপিত হয়েছে। তার ভাষায়,
“বছর কয়েক আমি ফকীর সন্নাসীর মত কেবল পথে পথে ঘুরেছি। ছায়া মারা গেল। ছায়া আমার কাছে যে কি ছিল তা আপনাকে বোঝাতে পারব না-আপনিও বুঝতে পারবেন না। দু বছরের মধ্যে এই মেয়েটি আমাকে আশ্চর্য রকমের বাঙালী করে ছেড়ে দিয়েছিল।” [পৃ. ৩৪]
ছায়া ছিল রাজনৈতিক-সচেতন শিক্ষিতা ও সংস্কৃতিমনা এক নারী। ডেভিডের ভাষায় সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ করত না, সে ছিল ভাসানীর রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস।
ডেভিডের সওয়াল-জওয়াবের মধ্য দিয়েই লেখক নিপুণভাবে ষাটের দশকের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যু এবং সেই তথাকথিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ধর্মীয় বিভেদের দু-একটি বিষয়ও জুড়ে দেন। ভাষা আন্দোলনের ইস্যুটিকে স্থান দেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও জনরোষের বিষয়টিকে তুলে আনেন। মার্চের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও বাদ পড়েনি। বাদ পড়েনি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের দু-একটি কথা, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যা পাও হাতের কাছে তাই নিয়ে যুদ্ধ কর। আমাদের সংগ্রাম চলছে-চলবে। আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-আমাদের এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শেরে বাংলা একে ফজলুল হকেরও নামও উৎকীর্ণ হয়েছে।
আখ্যান বিন্যাসে লেখক কৌশল যেন মনে হয় সিনেমার পর্দা ভেসে উঠছে ঘটে যাওয়া দৃশ্য। কিছুটা চেতনাপ্রবাহের রীতিও রয়েছে। ডেভিড ও পুলিশের কথোপকথনের মাঝে যুবকরা উধাও হয়ে গেছে, অর্থাৎ ডেভিডকে থাপ্পড় দেওয়ার পর সেই উদ্ধত যুবককে আর পাওয়া যায়নি এবং হঠাৎ হঠাৎ মেঝেতে শায়িতা অসাড় নাজমা পর্দায় ভেসে ওঠে। এ-রকম একটি দৃশ্যকল্প পাঠক দেখতে পায়,
উল্টে এসে সে মেঝের উপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে—দুপাশে দুখানা হাত পড়ে রয়েছে। আধাভেজা অবসথায়। মাথায় রুখু চুলগুলি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে রয়েছে মুখের চারিপাশে, পরনের কাপড়গুলো খুলে গেছে—পরনের ছায়া এবং ব্লাউজটা কোনরকমে তাকে আবরিত করে রেখেছে। তাও ব্লাউজটা তার ছেঁড়া এবং ব্লাউজটার ওই ছেঁড়া অংশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে মেয়েটির একটি স্তন; পূর্ণযুবতী কয়েক ফোঁটা দুধ আপনা থেকে বেরিয়ে এসে ফোঁটা বেঁধে টলটল করছে। ছেঁড়া ব্লাউজটা চটচট করছে, দুধে ভিজেছে এবং শুকিয়েছে। বুকের অনাবৃত অংশটাতে ঝরেপড়া দুধ এবং ধুলো মিয়ে জমে রয়েছে।
নাজমার স্বামী ২৬শে মার্চের রাতে গুলি খেয়ে মারা যায় এবং পর দিন তার বাবা অন্ধ ভিক্ষুক রহিমও পাকসেনাদের গুলিতে মারা যায়। নাজমার ছেলে চাঁদকে ও নাজমাকে বাঁচানোর জন্য ডেভিড ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় পথে পথে নানা রকম বাধাবিপত্তির বর্ণনা ডেভিড দিয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশেই পাকসেনা, বিহারী ও ইসলামপন্থী কয়েকটি দলের লোকজন একাট্টা হয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। হিন্দুদের ওপর নৃশংস নির্যাতন অবর্ণনীয়। এইসব অনুষঙ্গ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস পূর্ণতা পায় না। এই আখ্যানেও এ-রকম বর্বরতার কয়েকটি দৃশ্যকল্প চিত্রিত হয়েছে। একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়,
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। সারা দেশটা মার খেয়ে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে, তবুও ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়েনি। সারা দেশ জুড়ে পশ্চিম-পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রাম জ¦লছে মানুষ মানুষ মরছে গুলি খেয়ে, সব থেকে বেশী লাঞ্ছনা মেয়েদের, তাদের মেরে ফেলবার আগে দল বেঁধে পশুরু মত তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করছে। পথের ধারে নদীর ঘাটে গ্রামের মধ্যে উলঙ্গ নারীদেহ আকাশের দিকে তাকিয়ে পড়ে আছে। সারা দেহ রক্তে ধুলোতে মিশানো কাদায় কর্দমাক্ত হয়ে গেছে; কারোর বুকে গুলির ছিদ্র, কারোর পেটটা ফাঁসিয়ে দিয়েছে। সে দৃশ্য বীভৎস, সে দৃশ্য ভয়ঙ্কর। নাজমা আমাকে মধ্যে মধ্যে জড়িয়ে ধ’রে কেঁদে উঠে বলত বড় ভাইসায়েব, আমার কি অইব? বেয়নেটে বিঁধে মেরে ফেলা শিশুদেহ পড়ে আছে নারীদেহের পাশে। একতালা রক্তাক্ত মাংস। নাজমা তাঁর ছেলেটাকাকে বুকে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত। [পৃ. ৬৪]
ঔপান্যাসিক তারাশঙ্কর এই আখ্যানে আর একটি মানবিক, দেশপ্রেমিক ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যে চরিত্রটি এই আখ্যানকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে ঠিক তেমনই একাত্তর সালের এই দেশের বিভিন্ন অ লে পরিলক্ষিত হয়েছিল। এই চরিত্রটি হলো হাজী আব্বাস যিনি দেশভাগের আগে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী ছিলেন, বর্তমানে এদেশের সুপ্রতিষ্ঠিত জনদরদী ও মানবিক ব্যবসায়ী। তাঁর তিন স্ত্রীর ছয় ছেলে, বড়ো ছেলে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত নেতা। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হলো তাঁর বাড়ি। নাজমার ছেলে মারাত্মক জ¦রে আক্রান্ত হলে তাঁর সঙ্গে ঘটনাচক্রে দেখা হলে ওদেরকে আশ্রয় দেয় এবং ওদের সম্পর্ক জানতে পেরে ডেভিডকে বিয়ে করার পরামর্শ দিলে ডেভিড রাজি হয়নি। কিছু দিনের মধ্যে পাকিস্তানিদের আক্রমণে এক ছেলে গুলি খায়, আরেক ছেলেকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায়। এই ঘটনার জন্য দায়ী স্থানীয় বাসিন্দা আখতার। জাফরুল্লাহ হাজীসাহেবের সব ছেলেকে হত্যা করেছে, বাড়িঘর তছনছ করে দিয়েছে। পরিস্থিতি চরম সংকটাপন্ন হলে ডেভিড নাজমাকে নিয়ে ডেভিড আবার পালাতে থাকে।
পথিমধ্যে জাফরুল্লার হাতে ধরা পড়ে যে ধুরন্দর জাফরুল্লাহর হাতে। তার বাড়িটা হয়েছে যেন জল্লাদখানা ও হেরেমখানা। সে নাজমাসহ আরও অনেক তরুণীকে ধর্ষণ করে, নাজমার শিশুপুত্রকে গলায় পা দিয়ে চেপে হত্যা করে। তারপর হাজিসাহেবের নেতৃত্বে একদল তরুণ যোদ্ধা জাফরুল্লার আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে তাকেও হত্যা করে।
উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে নারকীয় হত্যাকা- এবং নারী নির্যাতনের কিছু ঘটনা। নাজমা হয়ে উঠেছে একাত্তর সালের নির্যাতিত লক্ষ লক্ষ নারীর প্রতীক। রূপকার্থে একটি বিধ্বস্ত বাংলাদেশ। থানায় আধমরা নাজমা মাঝে মাঝে কথনের মধ্যে ঢুকেছে তবে তা ছিল কেবল তার উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্য।
ডেভিড যে গুপ্তচর নয় সে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। এক ভিক্ষুককে কন্যাসহ ছায়া নিচে থাকার জায়গা দিয়েছিল। তার পর অসহায় নাজমাকে মানবিক সাহায্য করার জন্য ডেভিড তাকে নিয়ে ভারত গিয়েছিল। নাজমার প্রতি ডেভিডের কিি ৎ মানসিক টান সৃষ্টি হওয়ার আভাস পাওয়া যায় উপন্যাসে। নাজমাকে সে ভালোবাসে এবং যুদ্ধের পর নাজমাকে নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার আশাও ব্যক্ত করে।
ডেভিড ও নাজমা চরিত্র দুটি পাঠকের মনে দাগ কাটে। বিচিত্র চরিত্র। হাসান আজিজুল হক ভূমিকায় বলেছেন যে, “তিরিশের-চল্লিশ দশকের তারাশঙ্করকে এই উপন্যাসে খুঁজলে পাওয়া যাবে না। এটি এক টানে পড়ে শেষ করা যায়।” এই উপন্যাসের নির্মাণ ভিন্ন ধারার, চরিত্রগুলো বিচিত্র ভাষা সরল ও সহজবোধ্য হলেও বাংলা ইংরেজি ও উর্দুর মিশ্রণ রয়েছে ডেভিডের সংলাপে যা বেমানান মনে হয়নি বরং ডেভিডের চরিত্রকে আরও জীবন্ত ও বিশ^স্ত করে তোলা হয়েছে। সর্বোপরি, বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম গ্রন্থকারে প্রকাশিত উপন্যাস হিসেবে এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের গবেষণায় এটি অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। তারশঙ্করের অন্যান্য উপন্যাসের ভাষা নির্মিতি এবং ন্যারেশনের সঙ্গে কোনো পাঠকের কাছে এর কিছুটা দুর্বল্য দেখা গেলেও এর ভিন্ন নির্মাণ কাঠামো, প্রধান চরিত্র ডেভিডের সংলাপের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ উপন্যাসটি বা উপন্যাসিকাটি রচিত হওয়াতে এর আবেদন ও মেজাজ পাঠককে পূর্ণ সন্তুষ্টি দিতে পারবে বলে বিশ^াস। এই উপন্যাসে লেখকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ইতিহাস সচেতনতা এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা পরিস্ফুটিত হয়েছে। এই আখ্যানে লেখক ধর্মীয় বৃত্ত ভেঙে মানবতাবাদের উৎকর্ষ সাধন করেছেন ডেভিড, ছায়া ও নাজমা চরিত্র তিনটি সৃষ্টি করে। ডেভিডের বাবা ছিলেন স্বার্থপর এবং নিজের স্বার্থে তিনি ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করে শিশুপুত্রকে ফেলে চলে যান। পিতৃমাতৃহীন ভবঘুরে শিল্পী ডেভিড ছায়ার প্রতি যে প্রেম প্রকাশ করেছে তা তুলনাহীন। ধর্মের সকল বাধা ছিন্ন করে তার প্রেম হয়ে ওঠে মানবিক ও সীমাহীন। অনুরূপভাবে নাজমার জন্যও তার ভালোবাসা ও মানবতাবোধ সাধারণত্বের সীমা ছাড়িয়ে অসীমত্বের প্রান্ত স্পর্শ করে। কেননা, এক অন্ধ ভিক্ষুকের মেয়ে বিধবা ছন্নছাড়া কিশোরীর জন্য সে ভারতে না গেলেও এই দেশেই স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারত। নাজমার প্রতি তার শারীরিক সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত নেই, আছে ভাইবোনের ভালোবাসার মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বলা বাহুল্য যে, লেখকের অভিজ্ঞতা ও ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটে তার সাহিত্যকর্মে। ছায়ার রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ডেভিডের ইচ্ছে ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে বাম ঘরানার ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে। অবশ্যই, তখন বাংলাদেশে বাম ঘরনা ও মওলানা ভাসানীর অসংখ্য সমর্থক ছিল। তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবে কি না দ্বিধা-দ্বন্দ্বেও ছিল। তখন মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করে বাম ঘরানাদের একটি কথা সারা দেশে চাউর ছিল যে, দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি। ছায়া ও ডেভিডের রাজনৈতিক মনোভাব প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে লেখকের এদেশের রাজনৈতিক সচেতনতাও প্রমাণিত হয়। সর্বোপরি বলা যায়, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও লক্ষ লক্ষ মানুষের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের পরিপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া গেলেও পাঠককুল যুদ্ধের পটভূমি ও ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবেন।